অচল জীবন কবে সচল হবে
প্রকাশিতঃ 8:59 pm | May 01, 2020

ড. সিরাজুল করিম :
নিজের কোনো গাড়ি নেই। কখনো ধার করা আবার কখনো ভাড়া করা গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত ছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ আমি। এভাবে আসতে-যেতে মাঝে মধ্যে হাঁপিয়ে উঠতাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকতা প্রফেসর পদে উন্নীত অনেক আগে থেকেই।
এছাড়া একটা বিভাগের চেয়ারম্যান। ক্লাস ছাড়াও প্রতিদিন কিছু-না-কিছু প্রশাসনিক কাজ থাকে। কাজ সারতে সারতে কখনো বিকেল, কখনো সন্ধ্যা হতো। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষককে সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা হিসাবে গড়ে দৈনিক সাত ঘণ্টা অফিসে থাকতে হয়। আসলে শিক্ষকদের কোনো অফিস নেই। তবে আছে বসার রুম। একই রুমে একাধিক শিক্ষকের গাদাগাদি করে বসার ব্যবস্থা।
করোনার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ এখন নীরব ও নিথর। এলাকা নির্জন নিরিবিলি। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। থাকলেও আছে না থাকার মতো দু-একজন। তারা নির্বাক ও হতবাক। চেহারা মলিন, বিবর্ণ ও বিষন্ন।
আমি একজন হৃদরোগী। ডাক্তারের পরামর্শ মতো হাঁটতাম দু’বেলা সকাল ও সাঁঝের বেলা। এখন তা-ও বন্ধ। হাঁটার জন্য রাতের বেলায় ছাদে উঠে দেখি আকাশ ভরা তারা। ভরা চাঁদ আকাশে। এক টুকরো মেঘের চেষ্টা চাঁদকে আড়াল করার। কবির দৃষ্টিতে চাঁদ-তারার লুকোচুরি খেলা। আমার দৃষ্টিতে এ যেন চাঁদ-তারার মিলনমেলা। হাঁটাহাঁটি তো নয়, এ যেন স্বল্প পরিসর জায়গায় ঘোরাফেরা। দুধের স্বাদ নয়, যেন দুধের তেষ্টা ঘোলে মেটানোর চেষ্টা।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আগে কাজের মাঝে ডুবে থাকতাম। বয়সের ভারে মাঝে মধ্যে মন চাইতো অফিসে না যেতে। বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার একটা অফিস আছে।
ব্যাংকের চেকবই খুঁজতে গিয়ে একদিন অফিসে গেলাম। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক বিরানভূমি। দু’চোখ জলে ভরে এলো। ড্রয়ার খুলে চেকবই হাতে নিলাম। বইয়ে পাতা নেই! মনে পড়ল আনব আনব করে আনা হয়নি। ব্যাংকে গেলাম। ব্যাংক বন্ধ। পাশের এটিএম বুথে গেলাম। বলা হলো কার্ডের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। অসহায় ও নিরুপায় হয়ে একই ব্যাংকের অনতিদূরের ব্রাঞ্চে গেলাম। দেখলাম সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লম্বা লাইনে সারি সারি মানুষ দাঁড়ানো। বুক কেঁপে উঠল। গার্ডকে বললাম, ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে এসেছি। ম্যানেজারকে বললাম, আমি একজন প্রফেসর ও অমুক ব্যাংকের পরিচালক। এ বলে আমার ভিজিটিং কার্ড তার হাতে তুলে দিলাম। শ্রদ্ধাভরে সম্ভাষণ করে অদূরে চেয়ারে বসার অনুরোধ করেন। আর ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে টাকা উঠানোর সুযোগ করে দেন। জলভরা নয়নে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বাসায় ফিরে সহধর্মিণীর আঁচলে বরাবরের মতোই টাকাগুলো গুঁজে দিলাম।
করোনার কারণে হাতে সময় অফুরন্ত। কত চিত্র-বিচিত্র ভাবনা মনে! যেন ভাবনার মাঝে আমার বসবাস। কখনো মনে হয় পাপের ভারে জীবন আমাদের অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পাপ-সাগরের অতল তলে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি। পাপের কোনো অবশেষ আমরা রাখিনি। আমরা ইতোমধ্যে আরবের অন্ধকার যুগকেও ছাড়িয়ে গেছি। শুনেছি পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। জানি না পৃথিবীতে আজকের এ বিপর্যয় পাপের ফল কি না। মানুষ মারার জন্য এখন আর কোনো মারণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। প্রাণহানির জন্য করোনাভাইরাসের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবই যথেষ্ট।
শহরে নিজের কোনো বাড়ি নেই। তাই থাকি ভাড়া করা বাসায়। অক্ষমতা সত্ত্বেও সহধর্মিণী মাঝে মধ্যে তাগিদ দিতেন বাড়ি করার। বলতাম, সবার সব কিছু হয় না। সবার সব কিছু থাকে না। করোনার করুণায় বাসায় বসে বসে ভাবছি। পরিবেশের সবকিছু তো এখনো হারিয়ে যায়নি। এখনো অনেক কিছু আছে। অদূরে নদী আছে। নদীর কলতান আছে।
ভোরে পাখির কলরব আছে। তবে কোনো জনরব নেই। নেই কোনো কোলাহল। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ভাবনার পাখিরা যেন আকাশে ডানা মেলে ওড়ে। জীবনে দু’হাতে কত কাজের পাহাড় গড়েছি। কত পাহাড়-উঁচু কাজ করেছি। আর এ কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধার পাহাড় অতিক্রম করেছি। দীর্ঘ জীবনে কাজের চাপে কোথাও কখনো হার মানিনি। আজ আমরা হার মানছি করোনার কাছে।
করোনার আবির্ভাব ও প্রভাবে আমরা আজ আবালবৃদ্ধবনিতা অতিক্রম করছি কর্মহীন এক বন্দিজীবন। চলছে বন্দিদশায় আমাদের জীবনযাপন। প্রার্থনা করি প্রভুর দরবারে, এটা হোক সাময়িক। দিন গুনছি জীবন কবে আবার কর্মময় হবে। কর্মহীন জীবন কবে আবার কর্মময় জীবনে সম্প্রসারিত হয়ে কর্মকোলাহল ও কর্মমুখর হবে। আশায় আশায় দিন গুনছি অচল জীবন কবে আবার সচল হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, মৌল বিজ্ঞান বিভাগ, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়