অবৈধ কারখানায় বিষাক্ত কেমিক্যালে তৈরি হচ্ছে শিশুখাদ্য
প্রকাশিতঃ 11:53 am | February 23, 2022

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
বছরের পর বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার গণপরিবহণসহ ছোটখাট দোকান-টঙ দোকানে বিক্রি হচ্ছে বাহারি খাদ্যপণ্য। গণপরিবহন ও টঙ দোকানগুলোতে দেদারছে বিক্রি হওয়া এসব খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগেরই নেই কোনো মান। রঙিন মোড়কে মোড়া এসব পণ্যের নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদনও।
তবে টঙ দোকানের তুলনায় গণপরিবহনে থাকা ভ্রাম্যমান হকারদের বিক্রি করা পণ্যে বাহারি প্যাকেট ব্যবহার করা হলেও দেখা যায় না বিএসটিআই লোগো। তথ্য বলছে, নারায়গঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় গণপরিবহনে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগে পণ্যই আরএমএস ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ফুড লিমিটেড নামে একটি অনুমোদনহীন কোম্পানির তৈরি। পণ্যের মোড়কে নেই বিএসটিআইর অনুমোদনের সিল বা উৎপাদনের বিস্তারিত।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারী ও শিশুসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছে সেখানে। নেই কোনো খাদ্য বিশেষজ্ঞ, তারাই অনুমোদনহীন বিষাক্ত রাসায়নিক ও রং ব্যবহার করে শিশুদের কাছে আকর্ষণী খাদ্য তৈরি ও মোড়কজাত করছে।
অভিযোগ উঠেছে, গত চার বছর ধরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে প্রতি মাসে মোটা অংকে অর্থ মাসোয়ারা দিয়ে দাউদপুর ইউনিয়নের বীর হাটাবো এলাকায় এ কারখানাটি চলছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। প্রশাসনের নীরবতায় এলাকাবাসী এ অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এ ধরনের ভেজাল খাদ্যে শিশুরা পড়ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
কারখানা কর্তপক্ষও অবৈধভাবে কারখানা চালু রাখা ও অনুমোদনহীন খাদ্যপণ্য বিপণনের কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা দাবি করেছে, সব কিছু (সংস্থা) ম্যানেজ করেই ব্যবসা করছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আরএমএস ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানার মালিক ঢাকায় বসবাসরত ইউসূফ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। ইউসূফ চৌধুরী মাঝেমধ্যে কারখানায় এলেও কারখানাটি সম্পূর্ণ পরিচালনা করেন মোশারফ নামে একজন। তিনি কারখানার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কারখানায় বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে অংকুর লিচি, আরএমএস লিচি, শ্রাবণধারা আইসপপ/স্ট্রবেরি, আরএমএস লিচি ড্রিংক, ইডিবল জেলি, পুডিং, শ্রাবণধারা চকলেট থ্রি ইন ওয়ান, এটিএম গ্লাস ড্রিংক, জেলি, শ্রাবণধারা মিক্স ফ্রুটসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন শিশুখাদ্য। এসব শিশুখাদ্য তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র সস্তা রং, বিভিন্ন স্বাদের কেমিক্যালের মাধ্যমে।
এসব পণ্যে নেই বিএসটিআইয়ের কোনো লোগো। এছাড়া কারখানার নেই কোনো কল-কারখানা অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এ পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, গাজীপুর, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে।
এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ রূপগঞ্জের রাস্তায় হকাররা বাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে বিক্রি করছেন। এ কারখানার মালিকপক্ষ তাদের এ কেমিক্যামিশ্রিতল শিশুখাদ্য গণপরিবহনে বিক্রি করাচ্ছেন। সাধারণ মানুষও কম মূল্যে পেয়ে তাদের শিশুর জন্য কিনছেন খাবারগুলো। এতে এই নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রী খেয়ে কোমলমতি শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনটি বাইরে থেকে বন্ধ বোঝানোর জন্য কারখানার প্রধান গেটটি সারাক্ষণ বাইরে দিয়ে তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। ভেতরে নারী ও শিশু শ্রমিকসহ ৪০-৫০ শ্রমিক নানা ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি ও মোড়কজাতের কাজ করছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। নেই ফুড টেস্টিং ল্যাব ও কেমিস্ট। শ্রমিকরাই পানিতে মেশাচ্ছে নিম্নমানের রং ও বিষাক্ত রাসায়নিক। একাধিক নারী ও শিশুশ্রমিক জানায়, তাদের পারিশ্রমিক কম দিতে হয় বলেই শ্রমিক হিসেবে তাদের পছন্দ করা হয়। এদিকে কারখানাটির কোনো প্রকার অনুমতিপত্র নেই বলে জানিয়েছে, কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর। বিএসটিআইর কাছ থেকে কোনো প্রকার অনুমতি নেয়নি তারা। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, গাজীপুর, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করা হচ্ছে বিপণনও। আর এসব খাবার খেয়ে নানা রকম শারীরিক জটিলতায় পড়ছে শিশুরা।
এ বিষয়ে দাউদপুর ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, কারখানাটি শুরুতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করেছিল। তবে তারা অন্যান্য অনুমতিপত্র নিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নূরজাহান আরা খাতুন বলেন, খাবারের অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহারের কারণে ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, পেট খারাপসহ বিভিন্ন বড় ধরনের রোগব্যাধি হতে পারে। এসব ক্যামিকেলযুক্ত খাবার শিশুদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
জেলা কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন, এআরএমস কারখানা নামে কোনো কারখানা আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি। আর সেখানে শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো আরেকটি অপরাধ। আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ্ নূসরাত জাহান বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। বিএসটিআইর মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএসটিআইর পরিচালক (সিএম) নুরুল আমিন বলেন, কারখানাটি আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি। আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
কালের আলো/এআরবি/এমএম