মানবিক-অনুপ্রেরণীয় চিকিৎসকের প্রতিচ্ছবি কর্নেল সৈয়দা আলেয়া সুলতানা

প্রকাশিতঃ 10:23 am | March 08, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

সেবাই তাঁর কাছে যেন পরম ধর্ম। মানবসেবার মহান ব্রতের স্বপ্ন বুনেছিলেন সেই শৈশবে। বঞ্চনা-পশ্চাৎপদতার কঠিন সময়ে চিকিৎসা অঙ্গণে নারীর বিজয় পতাকা উড়িয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অখন্ডতার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র নারী অন্তবর্তী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে রীতিমতো এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক চিকিৎসক হিসেবে ক্লান্তিহীন পথচলায় দু’মুঠোতে ভরেছেন রাশি রাশি সাফল্য। নিজের নম্রতা, একাগ্রতা ও কর্তব্যপরায়ণতার নজির স্থাপনের মাধ্যমে পেশার প্রতি কমিটমেন্টকে নতুন এক উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন।

পেশাকে ইবাদতের মতো গ্রহণ করে রোগী ও স্বজনদের কাছে মানবিক বিনয়ী এক চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন কর্নেল সৈয়দা আলেয়া সুলতানা। সারল্য আর মানবপ্রীতিতে উদ্ভাসিত হয়েই রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) এই অন্তবর্তী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রোগীদের কাছে অপরিমেয় আস্থা ও সম্মান কুড়িয়েছেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও দেশের হৃদরোগ চিকিৎসক নারীদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গর্বের সঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে কর্নেল সৈয়দা আলেয়া সুলতানার নাম। তিনি মনে করেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত করেছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের বিশ্ব নন্দিত এই সাফল্য গোটা বিশ্বের কাছেই রোল মডেল। সেই ধারাবাহিকতায় সেনাপ্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদের যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে নারীর ক্ষমতায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।’

পথচলার শুরুর গল্প আর মুঠো মুঠো সাফল্য
মানবসেবায় থিতু হবেন-সৈয়দা আলেয়া সুলতানা এমন স্বপ্ন নিজের মানসপটে এঁকেছিলেন দুরন্ত শৈশবে। নিজের চিকিৎসক হয়ে উঠার পেছনে অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন স্নেহময় বাবা মোহাম্মদ সানাউল্লাহ। এক সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ঘাম-শ্রম, মেধা-শক্তি ও সামর্থ্যরে অপূর্ব সমন্বয়ে নিজের আলোকিত অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গড়েন।

১৯৮৫ সালে রাজধানীর হলিক্রস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কৃতিত্বের সঙ্গেই ১৯৯৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে করেন এমবিবিএস পাস। ২০০৮ সালে বিসিপিএস থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে চীনের সাংহাই সেকেন্ড মিলিটারি মেডিক্যাল থেকে, ২০১৫ সালে ইউরোপ কার্ডিয়াক সোসাইটি থেকে এবং ২০১৬ সালে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি থেকে ফেলোশিপ প্রাপ্ত হন।

কর্নেল সৈয়দা আলেয়া সুলতানাকে বিবেচনা করা হয় দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে সামরিক বাহিনীতে প্রথম এডাল্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং বাংলাদেশে প্রথম মহিলা ইপি কার্ডিওলজিস্ট (রিদম) হিসেবে। গত ১০ বছরে দেশের চিকিৎসা সেবার অনন্য মডেল রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) প্রায় ৯ হাজার রোগীর হৃদযন্ত্রের জটিল অস্ত্রোপাচারের সাফল্য ভরেছেন নিজের মুঠোতে।

এর মধ্যে আবার করোনাকালীন সময়েই প্রায় এক হাজার রোগীর হৃদযন্ত্রের জটিল অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে পূর্ণ আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন নিজেকে। ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি সরকার তাকে শান্তিকালীন অসামান্য সেবা পদক প্রদান করেন। সিঙ্গাপুর, তুরস্ক ও ভারত থেকে তিনি উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদের নির্দেশে সিভিল কার্ডিয়াক রোগীরা সিএমএইচে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছে ওয়ার্কশপ ও চ্যারিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে।

যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন-এই আপ্তবাক্যটি যেন একেবারেই মিলে যায় চিকিৎসক আলেয়া সুলতানার সঙ্গে। ঘরদূয়ার সামলে সন্তানদেরও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাঁর স্বামী সৈয়দ ইমতিয়াজ হোসেন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর। বর্তমানে বিআরবি এয়ার লিমিটেডের পাইলট। এ দম্পত্তির দুই সন্তান আনিসা সৈয়দা ইমতিয়াজ ও আসিম সৈয়দ ইমতিয়াজ। আনিসা বাংলাদেশের ইতিহাসে আমেরিকায় সর্বকনিষ্ঠ নারী ফ্লাইট ইন্সপেক্টর এবং আসিম ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডার শিক্ষার্থী।

‘আইকন’ যখন দেবী শেঠী
নিজের মেধা, মননশীলতা, একাগ্রতায় ক্রমশ নিজেকে মেলে ধরেছেন কর্নেল সৈয়দা আলেয়া সুলতানা। একজন রোগীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুসুলভ আচরণ তাকে করে তুলেছে মহিয়ান। উপমহাদেশের কিংবদন্তি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাইপাস সার্জারির সফল নায়ক ডা. দেবী শেঠীকে নিজের ‘আইকন’ ভাবেন।

বাংলাদেশে হৃদরোগের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে ডা: সৈয়দা আলেয়া সুলতানা বলেন, ‘রোগ হলেই কেবলমাত্র আমাদের দেশের মানুষ চিকিৎসকের দূয়ারে ছুটে। শরীরে চেকআপ করায় না। বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা, খাদ্যাভাস, ধূমপান ও ডায়াবেটিস হৃদরোগের জন্য দায়ী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নপূরণে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড.শিরিন শারমিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘ওমেন এজ ওয়ান’ চ্যাপ্টারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের নারী চিকিৎসকদের কার্ডিয়াক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়াতেও কাজ করে চলেছেন আলেয়া সুলতানা।

সেনাবাহিনীতে বাড়ছে নারীর ক্ষমতায়ন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বেও নারীরা সমাসীন। সৈয়দা আলেয়া সুলতানা সামরিক বাহিনীতে প্রথম এডাল্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে যেমন সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তেমনি দেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদের নেতৃত্বাধীন সময়ে সেনাবাহিনীতে প্রথম নারী মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন ডা. সুসানে গীতি।

গত বছরের ২০ অক্টোবর সেনাবাহিনীর চিকিৎসা প্রশাসনে (হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট) থেকে প্রথমবারের মতো নারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন নাজমা বেগম। নারী সৈনিক হিসেবে এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের সদর্প বিচরণ নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও নারী কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এসবের মাধ্যমে বিশ্ব পরিমন্ডলেও দেশের ভাবমর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। এছাড়া আর্মি এভিয়েশনেও মেয়েরা পাইলট হিসেবে যোগ দিচ্ছে।

কালের আলো/এনএল/এএএএম

Print Friendly, PDF & Email