এমন বেদনা আর আতঙ্কের ঈদ আর না আসুক
প্রকাশিতঃ 10:02 am | May 25, 2020

প্রভাষ আমিনঃ
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ধনী পরিবার এস আলম গ্রুপ। এই গ্রুপের মালিকদের নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আছে, সামর্থ্য আছে চট করে একটি হাসপাতাল বানিয়ে ফেলার, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বিশ্বের যেকোনো হাসপাতালে উড়ে যাওয়ার। সেই পরিবারে এখন করোনার হানা। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন এই পরিবারের দুই ভাই। ভেন্টিলেটরের ঘাটতি ছিল বলে, ছোট ভাইয়ের ভেন্টিলেটর খুলে বড় ভাইকে দেয়া হয়। কিন্তু এত চেষ্টা করেও বড় ভাইকে বাঁচানো যায়নি। এস আলম পরিবারের বড় ভাই মোরশেদ আলম করোনার থাবায় প্রাণ হারান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, সাধারণ সময়ে এস আলম গ্রুপের ড্রাইভারও হয়তো এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসবেন না।
এস আলম গ্রুপের পরিবারে এবার ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। শুধু এস আলম গ্রুপ নয়, বাংলাদেশে এখন এমন শত বা হাজার পরিবার আছে, যাদের কাছে ঈদ এবার আনন্দ বয়ে আনেনি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনারোগী শনাক্ত হয়েছে। এ লেখা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৬১০ জন, এদের মধ্যে মারা গেছেন ৪৮০ জন। তার মানে ৪৮০টি পরিবারে এবার ঈদের আনন্দ থাকবে না। আক্রান্ত বাকি পরিবারগুলোরও ঈদ কাটবে শঙ্কায়। শুধু যারা মারা গেছেন বা যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারাই নয়; অধিকাংশ মানুষেরই দিন কাটছে শঙ্কায়, আতঙ্কে।
করোনা কখন কার ওপর হামলা চালায় তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এই লেখা যখন লিখছি, তখনই খবর পেলাম করোনা কেড়ে নিয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মকবুল হোসেনের প্রাণ। তারও পারিবারিক বিশাল ব্যবসা রয়েছে, রয়েছে একটি মেডিকেল কলেজও। কিন্তু কিছুই তাকে বাঁচাতে পারেনি। করোনা দারুণ এক সাম্যবাদী ভাইরাস; শিল্পপতি থেকে রিকশাওয়ালা, সংসদ সদস্য থেকে বস্তিবাসী কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। অঢেল অর্থ বা অপরিসীম ক্ষমতাও কোনো কাজে আসছে না।
করোনা সাম্যবাদী ভাইরাস হলেও আমরা এরমধ্যে শ্রেণিবিন্যাস করছি। করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। আসলে ছুটির নামে প্রহসন চলছে। রাস্তায় নামলে বোঝার উপায় ছিল না, কী চলছে; সাধারণ ছুটি নাকি নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা? সরকারও এই বাড়ি ফেরা নিয়ে কত কিছু করল। প্রথমে বলা হলো, ঈদের আগে পরে সাতদিন কোনো মুভমেন্ট করা যাবে না। কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সরকারের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা দলে দলে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরলাম।
এরপর সরকার জানাল, গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে। ব্যস আর ঠেকায় কে, রেন্ট এ কারের ব্যবসা হলো জমজমাট। খালি একটাই ভয়, ঈদের পর দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণের যে জাম্প হবে তা সামাল দেয়ার সাধ্য আমাদের আছে তো? আমি সারাদিন প্রার্থনা করছি, আমার আশঙ্কা মিথ্যা হোক, বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়া কেউ করোনা আক্রান্ত না হোক।
তবে এভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি গিয়েও যদি আমাদের করোনা না হয়, তাহলে সরকার সব খুলে দিতে পারে। অযথা ঘরে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়ে অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে লাভ কী? আমরা অর্থনীতির বিনিময়ে জীবন কিনতে চেয়েছি। কিন্তু এখন অর্থনীতিও গেছে, জীবনও যাচ্ছে।
বলছিলাম আতঙ্ক, বেদনা, শঙ্কার কথা। দুই ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। একমাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদে আসে আনন্দ আর উৎসবের বারতা নিয়ে। ঈদ মানেই উৎসব। কিন্তু এবারের ঈদ উদযাপিত হচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলাদেশ কেন গোটা বিশ্বেই এমন আতঙ্কের ঈদ আর আসেনি, প্রার্থনা করি, কখনও না আসুক।
ঈদ আনন্দ আনে সবার ঘরে। সাধ্যমতো ভালো খাওয়া, শিশুদের নতুন জামা। এবার ঈদ বর্ণহীন। অনেক পরিবারেরই এবার নতুন জামা কেনার সামর্থ্য ছিল না। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের অনেকেও নীতিগত কারণে এবার শপিংয়ে যাননি। এবার ঈদের জামাত ঈদগাহে হবে না, মসজিদে হবে সীমিত পরিসরে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করা যাবে না, এমন অস্বাভাবিক ঈদ আর কখনও না আসুক।
করোনা একদিন যাবে, বেঁচে থাকলে আমরা আরও অনেক ঈদ করতে পারব। এখন আমাদের সবার দায়িত্ব সুস্থ থাকা, নিরাপদ থাকা, বেঁচে থাকা এবং আশপাশের সবাইকে নিরাপদ রাখা। আপনার একটু খামখেয়ালি কিন্তু আপনার পরিবারকে বিপদে ফেলতে পারে। তাই প্লিজ ঘরে থাকুন। প্রবীণ এবং অন্য কোনো অসুখ আছে, এমন কেউ মসজিদে যাবেন না। যারা যাবেন, তারাও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নামাজ শেষে বাসায় চলে আসুন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে সবার সাথে যোগাযোগ রাখুন।
এবারের ঈদ অন্যরকম। এই অন্যরকম ঈদটিকে আরও অন্যরকম করে তুলুন। সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু নিয়ে আপনার পাশে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ান। আনন্দ না হোক, সবাই যেন অন্তত খেতে পায়।
নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো আপনারা জীবনে অনেকবার শুনেছেন। ঠিক, কান দিয়ে শুনেছেন বটে; আজ একবার অন্তর দিয়ে শুনুন:
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ। তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’
আজকের ঈদে নিজেকেই বিলিয়ে দিন মানবতার কল্যাণে।