ইসলাম নারী-পুরুষের অধিকার সংরক্ষণ করে

প্রকাশিতঃ 2:32 pm | July 11, 2025

মাহমুদ আহমদ:

সমাজে নারী নির্যাতন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে আর এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতন, ধর্ষণ করে হত্যা, বিবস্ত্র করে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া এসব যেন আজ সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসলাম নারীদেরকে তাদের যথাযোগ্য সম্মানিত আসনে ভূষিত করেছেন। মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে শান্তির বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি পরিবার, সমাজ ও দেশের সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন আর এ ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন।

কেননা আল্লাহপাকের কাছে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ভিন্ন নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কর্মনিষ্ঠ কোন ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করবো না, তা সে পুরুষ হোক বা নারী।’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৯৫)।

এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, আমলের দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী, তাতে কিছু যায় আসে না। নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। সর্বত্রই নারীরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে। এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না, যেদিন নারী নির্যাতনের কোনো সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ না পায়। অথচ ইসলামে একজন নারীকে যে এত উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, তা যেন আজ আমরা ভুলতে বসেছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে নারীদের সাথে যে অন্যায় ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে তাতে মনে হয় আমরা আবার সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছি। আমরা কখনো দড়ি বেঁধে প্রকাশ্যে নারীর ওপর অত্যাচারের দৃশ্য দেখি আবার কখনো নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করা ভিডিও দেখতে পাই।

‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন,‘আল্লাহ তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, আল্লাহ তোমাকে যা পরতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পরতে দাও, এবং তাকে থাপ্পড় মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না।’

একটু চিন্তা করুন, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কেমন ছিল। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতো। রাতের বেলায় নারী মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব করতো। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাকর মনে করতো। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান করা হতো। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবিকূুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের আগমনের মাধ্যমে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে। তিনি সমাজে নারীদের সম্মান প্রতিষ্ঠা করেন।

নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বস্তুত কুরআন করিমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে মায়েদেরকে, স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদেরকে ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোনো ধর্মই এভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেনি।

একইভাবে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নারীদেরকে স্বামীদের সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে।

নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। একবার নামাজ পড়াবার সময় মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এজন্য নামাজ পড়ানো তিনি তাড়াতাড়ি শেষ করলেন। পরে বললেন, একটি বাচ্চা কাঁদছিল, আমার মনে হলো, ওর মায়ের মনে নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম, যাতে বাচ্চাটার মা তার বাচ্চার খবর নিতে পারে।’ (বুখারি, কিতাবুস সালাত)

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সফরে যেতেন, তখন মহিলারাও সঙ্গে থাকতেন, যার ফলে সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলিকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করলো, তখন তিনি বললেন, ‘আরে তোমরা করছো কি! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! অর্থাৎ, করছো কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবে উট দাবড়াতে থাকো, তাহলে তো ঐ কাঁচগুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।’ (বুখারি, কিতাবুল আদাব)

একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। এমনকি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও পড়ে গিয়েছিলেন। এক সাহাবী পিছন থেকে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পা তখনো রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ঐ সাহাবিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ঐদিকে, মেয়েদের দিকে যাও।’

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সব মুসলমানদেরকে সমবেত করে যে-সব ওসিয়্যত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি কথা এই ছিল যে, ‘আমি তোমাদেরকে আমার এই শেষ ওসিয়্যত (উপদেশ) করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একথাও প্রায়ই বলতেন, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শিখায়, এবং ভালোভাবে তরবিয়ত করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তার জন্য দোজখ হারাম করে দিবেন।’ (তিরমিজি)

সাধারণ আরবদের মধ্যে এটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীলোকরা যদি কোনো ভুল-ত্রুটি করতো, তবে তাদেরকে মারধর করা হতো। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নারীরা আল্লাহতায়ালার দাসী, তোমাদের নয়। তাদেরকে কখনোই মারধর করবে না।’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’ এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহে প্রথমবারের মত নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)

হজরত মাবিয়া আল কুশায়বি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘আমি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন,‘আল্লাহ তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, আল্লাহ তোমাকে যা পরতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পরতে দাও, এবং তাকে থাপ্পড় মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না।’ (আবু দাউদ)

ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার বিষয়টি ঘোষণা করে।

তাই আসুন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হই আর নারী-পুরুষ সবাই মিলে একটি সুন্দর শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ি। আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।