আলিশান বাড়ি-গাড়ির মালিক রেলের ট্রলিম্যান, নিজের নামে করেছেন সড়কও!

প্রকাশিতঃ 12:25 pm | February 12, 2022

কালের আলো সংবাদদাতা:

রেলের ট্রলিম্যান পদে চাকরি করেন মোহাম্মদ আলী। তবে তিনি রেলওয়েতে চাকরির নিয়োগ পেয়েছিলেন ওয়েম্যান হিসেবে। পরে পদ পরিবর্তন করে আসেন ট্রলিম্যান হিসেবে। কর্মরত আছেন রেলওয়ে বগুড়ার উর্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশল অফিসে (পথ) হেড ট্রলিম্যান পদে।

পদে ট্রলিম্যান হলেও তিনি আলিশান বাড়ি-গাড়ির মালিক এমনকি নিজের নামে করেছেন সড়কও। যদিও তার দাবি, এই নামকরণ এলাকাবাসীর ভালবাসা।

জানা গেছে, ট্রলিম্যান হলেও বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ গড়েছেন এই কর্মচারী। চলেন রাজার হালে। থাকেন স্যুটেট-বুটেট অবস্থায়। অফিসিয়াল নিয়ম-কানুন থোড়াই কেয়ার করেন। অফিসের আদেশও তিনি মানতে চান না। উল্টো তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের হুমকি দেন। রেলওয়ে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় রেলভূমির লাইসেন্সও পাইয়ে দেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি বরাদ্দের লাইসেন্স দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রেলের সম্পত্তিতে একাধিক দোকান ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে তার

শুধু তাই নয় অভিযোগ রয়েছে, নিজেকে ট্রলিম্যান হিসেবে দেখতে নারাজ মোহাম্মদ আলী। অফিস আদেশ অবজ্ঞা করে ব্যস্ত থাকেন দলীয় কর্মকান্ড নিয়ে। অফিস আদেশ অবজ্ঞার এক উদাহরণ উল্লেখ করে তার অফিসের উর্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জানান, সম্প্রতি তাকে বগুড়া রেলওয়ের আওতাধীন গাবতলি এলাকায় ৩২নং ব্রিজের নিকট একটি স্লিপারের কাজে যেতে বলা হয়েছিল। তবে অফিসের আদেশ অমান্য করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সান্তাহারে নিজ দলীয় কর্মকান্ডে।

এ বিষয়ে ট্রলিম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, ট্রলি ঠেলা তার কাজ নয়। কর্মকর্তা তাকে লিখিত অর্ডার দেননি। তাই ব্যক্তিগত কাজে সান্তাহার গিয়েছিলেন।

রেলের এক উর্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জানান, কাজের কথা বলায় কিছু দিন আগে তাকে গালিগালাজসহ গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হন তিনি এবং মারপিটের হুমকিও দিয়েছিলেন। ওই রেল কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও লাভ হয়নি।

এসব অভিযোগের বাহিরেও মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। কাহালু উপজেলার কানোড় গ্রামের মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, ভূ-সম্পত্তি বিভাগের কর্মচারী (আমিন) আব্দুর রাজ্জাকসহ একটি চক্রের নেতৃত্ব দেন ওই ট্রলিম্যান। কাহালু উপজেলার রেলওয়ের ১৭০নং প্লটের ৩ হাজার বর্গফুট ফাঁকা জায়গা রেলওয়ের নিকট থেকে স্ত্রীর নামে লাইসেন্স নেয়ার জন্য গত বছরের ২০ জুন বগুড়া কানুনগো অফিসে আসেন মিজান। সেখানে পূর্বপরিচিত ওই ট্রলিম্যান তাকে ১৫ দিনের মধ্যে লাইসেন্স নিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। প্রভাবশালী এই রেল কর্মচারীর কথা বিশ্বাস করেন মিজানুর রহমান।

মোহাম্মাদ আলী বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেয়ার কথা বলে এবং লাইসেন্স করিয়ে দেয়ার নামে কয়েক দফায় ৮ লাখ টাকা নেন। তবে প্রথমে তিনি ৫ বছর আগের তারিখে (ব্যাক ডেটে) বাণিজ্যিক লাইসেন্স দিয়েও তা পরে পরিবর্তন করে একই জায়গার আবার কৃষি লাইসেন্স দেন। এই লাইসেন্সও ব্যাক ডেটে (২০১৫ সাল) দেয়া। তবে খাজনা রশিদে ওভাররাইটিং ও লাইসেন্সে ব্যাক ডেট দেখে মিজানুর রহমানের সন্দেহ হয়। তিনি কানুনগো অফিসে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তাকে দেয়া লাইসেন্স ভুয়া। তার অভিযোগ মোহাম্মদ আলী আমিন আব্দুর রাজ্জাকের যোগসাজশে এই জালিয়াতি করেছেন।

আমিন আব্দুর রাজ্জাক তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেন। অভিযোগকারীকে তিনি চিনেন না বলে জনিয়ে বলেন, মোহাম্মাদ আলী রেলওয়ের স্টাফ হওয়ায় তিনি খাজনার রশিদ দিয়েছিলেন। তবে এটি তার ভুল ছিল।

সরেজমিনে জানা যায়, জালিয়াতি করে ট্রলিম্যান মোহাম্মাদ আলী অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন, যেখানে তিনি বেতন পান প্রায় ২০ হাজার টাকা। শহরের পুরান বগুড়া বিদ্যুত নগরে তার রয়েছে আলিশান চারতলা বাড়ি। এর পাশেই নির্মাণ করছেন আরেকটি তিনতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে রেলের চার শতক জায়গা রেলওয়ের নিকট থেকে কৃষিজমি হিসেবে দেখিয়ে লিজ নিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেখানে রয়েছে তার দোকান ও গোডাউন। এ ছাড়া তার স্ত্রীর নামে রেল সম্পত্তিতে আরও দুটি দোকান রয়েছে বলে রেল অফিস সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে, রেলওয়ের কোয়ার্টার ভাড়া দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এই কর্মচারীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বগুড়া রেলওয়ে কলোনিতে তার নামে একটি কোয়ার্টার (ই-৫০) বরাদ্দ থাকলেও তিনি সেখানে থাকেন না। সেটি ভাড়া দিয়েছেন অন্য এক ব্যক্তিকে, যেখানে রেলের কোয়ার্টার ভাড়া দেয়ার নিয়ম নেই। আর বরাদ্দপ্রাপ্ত কোয়ার্টার ছাড়াও তিনি ই-৮৩ নামে তিনটি কোয়ার্টার নিজের দখলে রেখে তিনজনকে ভাড়া দিয়েছেন। সরেজমিনে গিয়ে ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বললে এর সত্যতা মিলে। ভাড়াটে জানান, তারা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন মোহাম্মাদ আলীর কাছ থেকে। রেলওয়ের খাতায় অবশ্য রেল কলোনির এই কোয়ার্টারের হিসাব নেই। সূত্র জানায়, বাড়ির নম্বর ঠিকই রয়েছে। তবে কলোনির কিছু বাড়ি ভাঙ্গার আগে ওই বাড়ির নম্বর ছিল। মোহাম্মাদ আলী রেল কলোনির জায়গা দখল করে সেখানে কোয়ার্টার নির্মাণ করে ভাড়া দিলেও নম্বর লেখা রয়েছে ই-৮৩।

অন্যদিকে, পরিবহন ব্যবসায় একাধিক ট্রাক থাকলেও একটি ট্রাক থাকার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। তার দুই স্ত্রী রয়েছে বলে জানিয়েছেন। দুই স্ত্রী দুই এলাকাতে থাকেন। এর বাইরে অন্য কোন সম্পর্ক নেই বলে নিকট দাবি করেন ওই ট্রলিম্যান। তবে এ বিষয়ে নানা মুখরোচক কথা রয়েছে তার এলাকা ও রেল বিভাগে।

এ বিষয়ে ট্রলিম্যান মোহাম্মাদ আলী জানান, তার সম্পর্ক নিয়ে নানাজন নানা কথা বলতেই পারে। তার বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন অভিযোগকে একেবারে মিথ্যা বলে দাবি করেন। তার বক্তব্য- ঋণ করে বাড়ি বানিয়েছেন। রেলের ভুয়া লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টিও মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

ট্রলিম্যান মোহাম্মাদ আলী ও আমিন আব্দুর রাজ্জাকের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ডিভিশনাল এ্যাস্টেট অফিসার পুর্নেন্দু দেব। মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন গত বছরের ৭ নবেম্বর। তাদের বিষয়ে অভিযোগের বিষয়ে রেলওয়ে বগুড়ার উর্ধতন উপ-সহকারী (পথ) মাজেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রেললাইন পরিদর্শন ও দেখভাল তাদের অন্যতম কাজ। এ জন্য পরিদর্শন কাজে ট্রলিম্যান গুরুত্বপূর্ণ। তবে হেড ট্রলিম্যান ট্রলিতে কাজ করতে চান না, বললে নানা বাহানা ও অন্যদিকে চলে যান।

কালের আলো/এসবি/এমএ