চাচা আপন প্রাণ বাঁচা
প্রকাশিতঃ 10:46 am | May 11, 2020

প্রভাষ আমিন:
দেশে বা বিদেশে, ব্যাংকে আপনার যত টাকাই থাকুক; এই মুহূর্তে অসুস্থ হলে আপনি কোনো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পাবেন না। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স তো পাবেনই না; দেশেও খুব ভালো চিকিৎসা পাবেন না। করোনা হলে তো হাসপাতাল সীমিত। করোনা ছাড়া অন্য কোনো রোগে ভুগলেও আগের মতো দ্রুত ও উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও সময়মতো ভালো ডাক্তার পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই অর্থ আসলে অর্থহীন।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি নিরাপদ থাকা, সুস্থ থাকা। জরুরি তালিকার এক নম্বর হলো, করোনা থেকে দূরে থাকা। জীবন সবমসময়ই মূল্যবান। কিন্তু এখন জীবনই একমাত্র মূল্যবান। কিন্তু আমরা সবাই কি সেই জীবন বাঁচানোর বা করোনা থেকে দূরে থাকার চেষ্টাটা করছি?
সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি মেনে বড় অংশের মানুষ ঘরেই থাকছেন, এটা যেমন সত্যি; আবার বিশাল সংখ্যক মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করছে; এটাও তো মিথ্যা নয়। যারা অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা করছেন, তাদের কি জীবনের মায়া নেই? সরকারের আদেশ অমান্য করার বড়াই করতে গিয়ে কি আমরা নিজের জীবন দিয়ে দেব?
বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো জনসংখ্যা। ধরুন ঢাকার জনসংখ্যা দেড় কোটি। ৯৯ ভাগ মানুষ যদি সরকারের নির্দেশ মেনে ঘরে থাকে, তারপরও কিন্তু দেড় লাখ মানুষ বাইরে ঘোরাঘুরি করে। বাস্তবে কিন্তু অপ্রয়োজনে বাইরে বেরুনো মানুষ এক শতাংশের অনেক বেশি। তাছাড়া মানুষকে ঘরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ডাক্তার, সাংবাদিক, বাজার, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস-ইন্টারনেটসহ নানান জরুরি সেবা নিশ্চিত করতেও অনেককে বাইরে থাকতে হয়।
যাদের বাইরে থাকতেই হয় তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা অপ্রয়োজনে বাইরে বের হন, তারা নিজেরা তো ঝুঁকিতে থাকছেনই, ঘরে ফিরে ঘরে থাকা স্বজনদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন। অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া লোকজনই সবচেয়ে বিপদজনক। আমরা যারা সরকারের সমালোচনা করে ফেসবুক ফাটিয়ে ফেলি, তারা কি নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি?
করোনা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সরকার বিমানবন্দরে প্রবাসীদের যথাযথ চেক দিতে পারেনি, একটা ভালো কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানাতে পারেনি, টেস্ট করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারেনি, চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা করতে পারেনি। মুজিববর্ষে আতশবাজি ঠেকাতে পারেনি, যথাসময়ে ছুটি দেয়নি, ছুটির পর মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, লকডাউন কার্যকর করতে পারেনি, ঝুঁকি থাকার পরও আগেই লকডাউন শিথিল করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাখো মানুষের জানাজা ঠেকাতে পারেনি, বাজারে সমাগম ঠেকাতে পারেনি, ধানকাটার নামে ফটোসেশন ঠেকাতে পারেনি, এন-৯৫ মাস্কের দুর্নীতি এবং সে কারণে ডাক্তারদের ঝুঁকির মুখে ফেলা ঠেকাতে পারেনি, এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির প্রতিবাদকারীদের ওএসডি হওয়া ঠেকাতে পারেনি, সারাদেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারেনি। সব অভিযোগ ঠিক আছে। কিন্তু অভিযোগটা আপনি করছেন কোথায় বসে? বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে চায়ের দোকানে ১০ বন্ধু গোল হয়ে আড্ডা দিতে দিতে সরকারকে তুলোধুনো করছেন না তো।
সাধারণ ছুটি দিয়ে সরকার অর্থনীতির বিবেচনায় বিশাল ঝুঁকি নিয়েছে। আমাদের জীবন বাঁচাতে সরকার সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু আমরা কি সরকারকে সেই চেষ্টায় সহায়তা করছি? মানুষকে ঘরে বসিয়ে রাখার মধ্যে কিন্তু সরকারে কোনো লাভ নেই। আমাদের ভালোর জন্যই কিন্তু সরকার আমাদের ঘরে রাখতে চায়। কিন্তু নিজেদের ভালোটা বুঝতে চাইছি না। সরকারকে ফাঁকি দেয়ার নানান কৌশল বের করেছি আমরা। পুরোনো প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি বা চেকবইয়ের একটি পাতা পকেটে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যাই। বাজারের সামনে পার্ক করা গাড়িতে বড় করে লেখা ‘কিডনি রোগী’।
দুদিন আগে একজন জানালেন, পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে রীতিমতো বাইকারদের প্রতিযোগিতা হতে দেখেছেন তিনি। সেই বাইকাররা কারা? তাদের অভিভাবক কারা? তাদের কী প্রয়োজন বাইরে বেরুনোর? এ ধরনের বাইকার বা অপ্রয়োজনে বাইরে আসা মানুষদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। মোটা অঙ্কের জরিমানা, প্রয়োজনে মাইর বা গ্রেফতার করলেও আপত্তি নেই। এই গ্রুপ সরকারের যেটুকু চেষ্টা তাও নষ্ট করে দিচ্ছে। এই গ্রুপের কারণে সাধারণ ছুটি থেকে সরকার পুরো সুবিধাটা নিতে পারছে না।
করোনার সময় আসলে এক ধরনের স্বার্থপরতার। আগে মানুষ দেশের সেবা করতে ঘর থেকে বের হতো, এখন ঘরে থাকাই দেশের সেবা। অন্য দুর্যোগের মতো এবার ত্রাণ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। এবারের দুর্যোগে একমাত্র সমাধান ঘরে থাকা, সম্ভব হলে ঘরে থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকা। তাই সরকার কী করলো না করলো, তার হিসাব না করে নিজেকে আগে নিজে নিরাপদ করুন। পুরোনো প্রেসক্রিপশন পকেটে নিয়ে বা গাড়িতে কিডনি রোগী লিখে বাজারে গেলে সরকার আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। বাজার খোলা আছে, তাই বলে আপনাকে প্রতিদিন বাজারে যেতে হবে, এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি। অথচ অন্য সময়ের চেয়ে এখন বাজারে যেন ভিড় বেশি।
ছুটির আমেজে সবাই একটু ভালোমন্দ খেতে চায়। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ধীরে ধীরে ‘লকডাউন’ শিথিল করছে। শপিংমল খোলার অনুমতি দিয়েছে। আপনাকে তো সরকার বাধ্য করেনি শপিংমলে যেতে। এই দুর্যোগের সময় আপনার যদি শপিং করতে মন চায়, যান। কিন্তু শপিং সেন্টার থেকে করোনা আক্রান্ত হলে কিন্তু সরকারকে দোষ দেবেন না। তবে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ধন্যবাদ সরকার শপিংমল খোলার অনুমতি দিলেও অনেক বড় বড় শপিংমল কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবসায়ী সমিতি নিরাপত্তার স্বার্থে বেশিরভাগ শপিংমল না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরও আড়ং, বাটা, এপেক্সসহ কিছু ছোট ছোট দোকান খুলেছে।
আমি ভেবেছিলাম খুললেও কেউ দোকানে যাবে না। কারণ এই সময়েও কারও মাথায় শপিংয়ের চিন্তা আসতে পারে এটা আমার মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে যেসব দোকান খুলেছে সেখানে অনেকেই গেছেন, কেনাকাটাও করেছেন। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়েছে, কোথাও হয়নি। এখন শপিংয়ে যাওয়ার কারণে যদি আপনি করোনা আক্রান্ত হন; নিশ্চয়ই সরকারেরই দোষ হবে। অবশ্যই সরকারের দোষ। সরকারেরই তো আমাদের দেখে রাখার, আমাদের সুস্থ রাখার, অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব।
শপিংমল খোলার সিদ্ধান্ত হওয়ার সাথে সাথে প্রবল জনমত- গার্মেন্টস খোলা, বাজার খোলা, শপিংমল খোলা; তবে মসজিদ বন্ধ কেন? কঠিন যুক্তি। বাধ্য হয়ে সরকার খুলে দিল মসজিদ। যথারীতি মসজিদে উপচেপড়া ভিড়। দুয়েক জায়গায় হলেও বেশির ভাগ মসজিদেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। তাতেও ভিড় কমেনি। এখন আল্লাহ না করুন, যদি মসজিদ থেকে কেউ করোনা আক্রান্ত হন; সেটাও কি সরকারের দোষ হবে?
আচ্ছা সরকার খোলার অনুমতি দিলেও বেশিরভাগ শপিংমল কিন্তু খোলেনি। ব্যবসায়ীরা বুঝেছেন, অর্থের চেয়ে জীবনের দাম বেশি। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো বেঁচে থাকা। তাই সরকার সিদ্ধান্ত দিলেও ব্যবসায়ীরা কিন্তু দোকান খোলেননি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মসজিদ কর্তৃপক্ষ কিন্তু নিজে থেকে মসজিদ বন্ধের ঘোষণা দেয়নি। অথচ শপিংমল বা বাজারের মতো মসজিদও কিন্তু করোনা বিস্তারের বড় কেন্দ্র।
সরকার মসজিদ খুলে দিয়েছে, শপিংমল খুলে দিয়েছে বাজার আগে থেকেই খোলা; কিন্তু সরকার কিন্তু কোথাও যেতে আপনাকে বাধ্য করেনি। সব ধরনের জনসমাগমই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা মসজিদই হোক আর বাজারই হোক। এখন সিদ্ধান্ত আপনার, আপনি নিজের জীবনের ঝুকি নেবেন নাকি বাসায় বসে প্রার্থনা করবেন, শপিংমল বর্জন করবেন, অতি জরুরি না হলে বাজারে যাবেন না।
হাশরের ময়দানে নাকি সবাই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করবে। এখনই একবার রিহার্সাল করুন। দেশ-জাতি-অর্থনীতি নিয়ে আপনার ভাবার দরকার নেই। সেটা নিয়ে ভাবার অনেক লোক আছে। সরকার আছে, গবেষকরা আছে। আপনি শুধু ঘরে বসে থাকুন। প্রয়োজনে ঘরে বসে সরকারের সমালোচনা করুন। তবুও বাইরে বের হবেন না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম বা চাচা আপন প্রাণ বাঁচা; যেটা ভেবেই হোক, আপনি নিজে নিরাপদ থাকুন, পরিবারকে নিরাপদ রাখুন। স্বার্থপর হোন, তবু ভালো থাকুন।