জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি
প্রকাশিতঃ 10:15 am | May 09, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
রফতানিকারকদের কারখানা খুলেছে, রেস্তোরাঁ সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে, মসজিদ খুলেছে এবং কাল থেকে শপিংমল এবং দোকানপাট খুলবে। যদিও লকডাউন কথাটি বলা হয়নি, তবুও ৪৫ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে সরকার বেশ কিছু বাস্তবতা মাথায় রেখে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
অনেকেই মনে করছেন বা বলতে শুরু করেছেন, তবে কি আমরা একটা ঝুঁকি নিলাম বড় ধরনের? কিংবা কোভিড-১৯ এর মোকাবিলায় আমরা হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটছি? এই সমস্ত ভাবনাই নাগরিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের। যাদের উপায় নেই, তারা জানে পেটে গামছা বেঁধে লকডাউনে আটকে থাকা যায় না। তাই সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব সদস্যদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বহু মানুষ বাইরে এসেছে।
শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে উদাসীন জনগণের অবাধ মেলামেশায় দাঁড়ি টানতে আমরা পারিনি সেভাবে যেভাবে প্রয়োজন ছিল। এদের ভেতর অনেকে যেমন হতদরিদ্র আছে, যারা ত্রাণ চাইছে, তেমনই আছে যাদের কাজ ছিল, নিয়মিত রোজগার ছিল, যারা ত্রাণ চাইতে পারবে না, কিন্তু সন্তানের ক্ষুধার্ত মুখে কিছু একটা দেয়ার আশায় কাজ খুঁজতে হবেই।
তাহলে কি সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের প্রাসঙ্গিকতা আর রইল না? ঠিক এতটা সরলও নয় বিষয়টা। সরকার অফিস খোলেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে ৩০ মে পর্যন্ত। কিন্তু সরকারকে আমাদের দেশের নিজস্ব বাস্তবতাও ভাবতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার মানুষের খেতে না পাওয়ার থেকে কখনোই বড় হতে পারে না তাকে আটকে রাখা। আর সে জন্যই হয়তো বিকল্প ছুটি শিথিল করে ভিন্ন পথে চলছে সরকার। সরকারি আদেশে নির্দেশে পরিষ্কারভাবে আছে যে, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা চালানো যাবে। এখন মানুষ সেটা কতটা মানবে, সেটাই বড় বিষয়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যু হবেই, বিষয়টা ঠিক এমনটা নয়। কিন্তু এই মহামারি বহু বাণিজ্যের মৃত্যু ডেকে এনেছে। আমাদের দেশ এর বাইরে তো নয়ই বরং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই অভিঘাতের নানা মাত্রা আছে। আমাদের কত ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে তার পরিসংখ্যান জানা না গেলেও বুঝতে সমস্যা হয় না যে আমাদের লাখো মানুষ রোজগার হারিয়েছে, সঞ্চয় ভেঙে খেতে খেতে নিঃস্ব হতে চলেছে।
এই মহামারির বিপর্যয় গোটা দুনিয়ায় এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ কমে -৩ শতাংশে নেমে যাবে। এই মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে সারাবিশ্বের জিডিপির মোট ক্ষতি হবে নয় লাখ মার্কিন ডলার। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) বলছে, করোনাভাইরাসের থাবায় দেশে দেশে কাজ বন্ধ থাকায় সারাবিশ্বের ৮১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ নিদারুণ কষ্টে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ভুগছে যারা অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মে নিয়োজিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচয়ে বড় আঘাত শ্রমজীবীদের জন্য।
এই বিপর্যয়ের কথা সরকার জানে বলেই আমরা আশা করছি। জনস্বাস্থ্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটি নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে শুরু করা যায় সেটাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এটা করতে না পারলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। প্রথমত সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোকে সম্প্রসারিত করতে হবে।
রফতানিকারকদের যেমন প্রণোদনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, তেমনি তিনি কৃষকের কথাও ভেবেছেন। কিন্তু তবুও দাবি থাকে অনেক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বাণিজ্যকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এখন সরকারের আর্থিক সহযোগিতা বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই খাতের সাথে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। এদের বাঁচাতে না পারলে অন্যান্য খাতেও বড় চাপ সইতে হবে।
আরেকটি বিষয় এর মধ্যেই বড় আলোচনায় চলে আসছে। বেসরকারি খাতে ছাঁটাই ও মজুরি হ্রাসের মতো বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এসব কাণ্ড দেশ ও শ্রমিক স্বার্থ পরিপন্থী। শুধু মুখে মুখে হুঁশিয়ারি নয়, সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেন এই সুযোগে অন্যায়ভাবে এসব কাণ্ড করতে না পারে। কারণ কর্মচ্যুত মানুষ অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে ভূমিকা রাখে। একটি বড় কাজ হলো এই কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যেন তারা মনোবল হারিয়ে না ফেলে। সেটা কীভাবে হবে সেই আলোচনা হোক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকে এই সংকটকে মোকাবিলা করছেন মেধা ও ধৈর্যের সাথে। তিনি নানা ধরনের কাজ করে জনস্বাস্থ্য সেবাদানের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কিন্তু একক ব্যক্তিবিশেষের ক্যারিশমায় আমরা করোনাকে রুখে দিতে পারব না। সংক্রমণ রুখতে সরকারি নির্দেশিকা মেনে প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব হবে সব কাজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা।