গ্রাহকের ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা ‘এলটি মার্কেটিং’

প্রকাশিতঃ 11:16 am | February 14, 2022

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে যুবক, ডেসটিনি ও ইউনি পে টু ইউ-এর মতো খুলনার ‘এলটি মার্কেটিং লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের প্রতারণার ফাঁদে নিঃস্ব গ্রামের গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজারো মানুষ।

জানা গেছে, বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের সহজ-সরল মানুষদের থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে এলটি মার্কেটিং লিমিটেড। তারা দুই বছর আগে কার্যক্রম শুরুর সময় অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে আয়ের সুযোগ দেয় গ্রাহকদের। এ কার্যক্রমের পাশাপাশি শেয়ার ও ডিলার বিক্রি, টি-শার্টসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি শুরু করে। পরে মোবাইল রিচার্জ ব্যবসার নামে প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতে। নিবন্ধিত গ্রাহকদের টাকা নিয়ে শপিং মল, এলটি ফিড, গার্মেন্টস কারখানাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এমনই এক ভুক্তভোগী খুলনার কয়রা উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের ভ্যানচালক সবুজ। তিনি জানান, এক আত্মীয়ের প্ররোচনায় তিনি লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ১৪ হাজার টাকা দিয়ে এলটির ১৪টি টি-শার্ট কেনেন। শুরু করেন স্মার্টফোনের মাধ্যমে কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখার কাজ। দ্রুত লাখপতি হওয়ার বাসনায় গরু ও ভ্যান বিক্রি করে ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন এলটির আইডি। আইডিতে এখন ৪০ হাজারের বেশি টাকা জমা হলেও তুলতে পারছেন না তিনি।

সবুজের চাচি আমেনা জানান, দিনমজুর স্বামীর সংসার খরচ থেকে অল্প অল্প করে জমানো ১৪ হাজার টাকা দিয়ে তিনি আইডি খুলে ওয়ান স্টার হন। এখন তার সব টাকায় জলে গেছে। এভাবে এলাকার বাবু, মোস্তাফিজুর রহমানসহ অনেকেই এলটির প্রতারণার শিকার হয়ে এখন পথে বসতে চলেছেন। মোস্তাফিজুর নিজে ১৪ হাজার টাকা দিয়ে আইডি কিনে ওয়ান স্টার হন। পরে অন্য গ্রামের এক শিক্ষককে দু-স্টার বানানোর লোভ দেখিয়ে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়ে তার ১৪৪টি আইডি কিনে দেন। সব টাকায় এখন ধরা খেয়েছেন। মোস্তাফিজুর নিজের টাকা নিয়ে চিন্তা না করলেও চরম বিপদে পড়েছেন ওই শিক্ষকের টাকা পরিশোধ নিয়ে।

শুধু সবুজ, আমেনা, বাবু কিংবা মোস্তাফিজুর নয়, ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার শত শত মানুষ কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্ররোচণায় প্রলোভনে পড়ে লাখপতির আশায় আইডি খুলে খুইয়েছেন অর্থ-সম্পদ, অনেকে হয়েছেন নিঃস্ব।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই কোম্পানিতে সারা দেশের ৪ লাখের বেশি আইডির মাধ্যমে প্রায় ২ বছরে ৪০ কোটি টাকার ওপরে জমা পড়ে। তবে একজন একাধিক আইডি খোলায় সক্রিয় কর্মী রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার। যার অধিকাংশই খুলনা বিভাগের মানুষ। আর খুলনা বিভাগের মধ্যে বেশি ছড়িয়েছে ঝিনাইদহ ও খুলনা জেলায়। কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, গ্রাহকের প্রতি আইডির দাম এক হাজার টাকা। আর এক আইডি দিয়ে ২২০ দিন পর্যন্ত দৈনিক বিজ্ঞাপন দেখে পাওয়া যাবে ১২ টাকা। আর ১৪টি আইডি খুললে তাকে দেয়া হয় ‘ওয়ান স্টার’, ১৪৪টি আইডি খুললে ‘টু স্টার’ এভাবে গ্রাহককে প্রলোভন দেখিয়ে নতুন নতুন আইডি খুলিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

কোম্পানিটি শুরুতে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে গ্রাহককে টাকা তোলার সুযোগ দিলেও যখন এই গ্রাহকের প্রদত্ত অর্থ ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যায় তখনই বেরিয়ে আসে কোম্পানিটির আসল চেহারা। আরও জানা যায়, টি-শার্ট বিক্রি করে টাকা নেয়ার পাশাপাশি তাদের শেয়ার ও ডিলার বিক্রিসহ গ্রাহকের বিজ্ঞাপন দেখা অর্থ পরিশোধ না করে মোবাইল রিচার্জ ব্যবসার নামে নতুন প্রতারণার ফাঁদ। তাছাড়া আরও চালু করে ১৪/২০ নামের আরেকটি প্রতারণার ফাঁদ।

এলটির চেয়ারম্যান শামীম। তার বাড়ি ঝিনাইদহে। এমডি হিসেবে আছেন একই জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের খোরশেদ আলম। আর কর্মকর্তা হিসেবে আছেন বাবুল ও আবদুর রাজ্জাক। বাকিদের মধ্যে নড়াইলের হামিম, যশোরের নওয়াপাড়ার তৌহিদ ও চট্টগ্রামের কামরুল ইসলাম রিয়াদ রয়েছেন।

২০২০ সালে এলটি ব্যবসা শুরু করে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে কোম্পানির নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। তাতে কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া ২১৩/৪ এফ-৩ শাপলা হাউজিং পশ্চিম আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির এমডি খোরশেদ আলম ও চেয়ারম্যান শামীমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে পরিচালক হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম তাজের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি জানান, ৪ লাখের বেশি আইডি রয়েছে। আর তারা বাইনারী পদ্ধতিতে ই-কমার্স ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে লভ্যাংশ গ্রাহকের মধ্যে বণ্টন করছেন।

এমএলএম’র সিস্টেমে করছেন কিনা এবং এমএলএম’র লাইসেন্স আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি এমএলএম নয়, ই-কমার্স। আর জয়েন্ট স্টকের ব্যবসায়িক লাইসেন্স রয়েছে।

ব্যবসা করলে নিম্নমানের একটি টি-শার্টের মূল্য ১ হাজার টাকা নিচ্ছেন কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একই পণ্যের দাম স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। গ্রাহকের টাকা উইড্রো’র বিষয়ে জানান, ই-কমার্স খাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করায় সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। তবে মার্চের প্রথমদিকে সমাধানে আসতে পারবেন তারা।

কালের আলো/ডিএস/এমএম