খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিতঃ 10:37 am | September 06, 2021

প্রভাষ আমিন :

অবস্থাটা হয়েছে মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের মত। এর আগে একাধিকবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু করোনার দাপটের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে এবার মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে। শিক্ষামন্ত্রী তারিখও ঘোষণা করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রায় দেড়বছর পার আগামী ১২ সেপ্টেম্বর খুলছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানারকম ট্রল হচ্ছে। কেউ শিক্ষা স্কুল-কলেজের নাম ভুলে গেছে, কোন ক্লাশে পড়তো তাও ভুলে গেছে, কেউ স্কুল ড্রেস খুঁজে পাচ্ছে না, কারো স্কুল ড্রেস ছোট হয়ে গেছে। করোনার সংক্রমণের হার দ্রুত কমে আসাতেই সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পেরেছে। এরইমধ্যে সংক্রমণের হার ১০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে শিক্ষাঙ্গন, এই ভাবনাটাই আমাকে দারুণ আনন্দ দিচ্ছে। করোনা স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে এখন আর আগের মত অভিভাবকরা শিক্ষার্থীর সাথে স্কুলে না গেলেই ভালো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে স্থিতিশীল থাকলে পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক বিবেচনা করে। তবে এবার বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান হলো, সংক্রমণের হার ৭/৮ শতাংশ হলেও এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। আমার ধারণা ১২ সেপ্টেম্বরের আগেই সংক্রমণের হার আরো কমে আসবে। সে ক্ষেত্রে সরকার অনেক নিশ্চিন্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য বিবেচনায় সরবকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছিল গত বছরের ১৭ মার্চ। তারপর করোনার অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। এক ঢেউ গিয়ে আরেক ঢেউ এসেছে বা গিয়েছে। অফিস-আদালত-পর্যটন কখনো বন্ধ ছিল, কখনো খোলা ছিল।

এই সময়ে সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন- নানাকিছু হয়েছে; কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর খোলেনি। অথচ উইনেস্কো এবং ইউনিসেফের নীতি হলো, যে কোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে সবার পরে, খুলবে সবার আগে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে উল্টো। বাংলাদেশের চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। তবে কী হয়েছে, কী হতে পারতো; সে আলোচনায় না গিয়ে এখন সামনে তাকাতে হবে।

সরকার নির্ধারিত সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিল, আর সবাই সুর সুর করে ক্লাশে চলে এলো। তারপর সবাই সুখে-শান্তিতে ক্লাশ-পরীক্ষা দিতে লাগলো; ব্যাপারটা রূপকথার গল্প বা সিনেমার মত এমন হ্যাপি এন্ডিং নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে সরকারকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, দেড়বছর বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার জন্য তৈরি করা। করোনার আগে মাথায় রাখতে হবে ডেঙ্গুর কথাও।

এতদিন বন্ধ থাকায় কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়তো ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। তাই খোলার আগে সাধারণ পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি পানি জমার মত সকল উৎস সরিয়ে ফেলতে হবে। তারপরের চ্যালেঞ্জ হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। এই চ্যালেঞ্জটা বড়, কারণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বিপুল শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের গাদাগাদি করে ক্লাশ করতে হতো। নতুন পরিস্থিতিতে সব শিক্ষার্থীর মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সহজ হবে না। তাছাড়া স্কুলে ঢোকার সময় সবার হাত ধোয়া, স্যানিটাইজ করা, তাপমাত্রা পরীক্ষা করাটাও কম কঠিন নয়।

এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাস্ক পরানো এবং আমার বিবেচনায় এটা সহজেই করা সম্ভব। মাস্ককে স্কুল ড্রেসের অন্তর্ভুক্ত করে দিলেই সেটা সম্ভব। অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শহরে যতটা সহজ, গ্রামে ততটাই কঠিন। সরকারের যে পরিকল্পনা তা পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারলে শিক্ষার্থীরা হয়তো নিরাপদই থাকবে। কিন্তু পরিকল্পনার পুরোটা বাস্তবায়ন কঠিনই নয় শুধু, অসম্ভবও বটে।

আগেও আমরা দেখেছি শপিং মল, গণপরিবহন বা পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও তা করা যায়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেন ঢিলেমি না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেটা করা গেলে আমাদের সন্তানদের নিশ্চিন্তে স্কুলে পাঠাতে পারবো আমরা।

অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পরই আসবে আসল চ্যালেঞ্জ। হার্ডওয়্যারের চেয়ে সফটওয়্যার সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। দেড়বছরে শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষণ ঘাটতি হয়েছে, তা কখনোই পূরণ করা যাবে না। আবার ব্যাপারটা এমনও নয় যে, শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ দিয়ে, বাড়তি ক্লাশ নিয়ে দেড়বছরের ঘাটতি দেড় মাসেই পুষিয়ে ফেলা যাবে। সেটা করা ঠিকও হবে না। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে তলতে হবে।

গত দেড়বছরে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন রুটিন এবং জীবনাচরণ বদলে গেছে। এখন শিক্ষার্থীরা রাতভর জেগে থাকে, দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। স্কুল খুললে তাতের আবার সকালে উঠতে হবে। অনলাইন ক্লাশের অভ্যাস থেকে সত্যিকারের ক্লাশরুমে অভ্যস্ত হতে হবে। এই দেড়বছরের শিক্ষার্থীদের অনেকে অনলাইন ক্লাশের পাশাপাশি নানারকম অনলাইন গেমেও আসক্ত হয়ে গেছে। তাদের সে আসক্তি দূর করার বিষয়টিও ভাবনায় রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। দেড়বছর ঘরবন্দী থেকে কার মনোজগতে কী পরিবর্তন এসেছে আমরা জানি না। স্কুল খুললে সেটা টের পাওয়া যাবে। শিক্ষকরা যেন শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তনের বিষয়টিও খেয়াল রাখেন।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সব শিক্ষার্থীকে ক্লাশে ফিরিয়ে আনা। সাধারণ সময়েই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে লেখাপড়া ছেড়ে দেন। দারিদ্র, নানা সাসাজিক বাধা তাদের স্কুলে আসতে দেয় না। এই দেড়বছরে এই আশঙ্কা আরো বেড়েছে। শিশুদের অনেকেই নানারকম কাজে যুক্ত হয়ে গেছেন। তারা হয়তো আর কখনো ক্লাশে ফিরবে না। করোনা অনেকব পরিবারকে আরো দরিদ্র করেছে। অনেক অভিভাবকই হয়তো সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন।

এই সময়ে বাল্যবিয়ে বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। অনেক দরিদ্র পরিবার দেড়বছর মেয়েদের ঘরে বসিয়ে না রেখে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। সবাইকে হয়তো কখনোই আর ক্লাশে ফেরানো যাবে না। তবে যত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ক্লাশে ফেরানো যায়, সেই চেষ্টাটা করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকার মুরুব্বীদের কাজে লাগাতে হবে। তারা অভিভাবকদের সাথে বসতে পারেন। ড্রপআউটের ঝুকিতে থাকা শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের কোনো প্রণোদনা দিয়ে স্কুলে ফেরানো যায় কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই দেড়বছরে অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের শিক্ষার্থীরা কোথায় ফিরবে, সেটাও ভাবতে হবে।

সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে এই চ্যালেঞ্জ আমাদের জিততেই হবে। কারণ এই চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে শিক্ষাঙ্গন, এই ভাবনাটাই আমাকে দারুণ আনন্দ দিচ্ছে। করোনা স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে এখন আর আগের মত অভিভাবকরা শিক্ষার্থীর সাথে স্কুলে না গেলেই ভালো। তবে আমার ইচ্ছা হলো, যেদিন খুলবে, সেদিন দূর থেকে হলেও কোনো একটা স্কুলের ক্যাম্পাস দেখবো। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে খেলছে, চিৎকার করছে, হইচই করছে; এরচেয়ে সুন্দর কোনো দৃশ্য নেই।
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএননিউজ।