মৃত্যুতেও বৈষম্য!
প্রকাশিতঃ 10:22 am | April 27, 2020

প্রভাষ আমিন :
করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বে অদ্ভূত এক সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে যেমন ছড়িয়েছে, তেমনি এশিয়ার অনুন্নত দেশও বাদ যায়নি। কোনো না কোনোভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিস্তৃত হয়েছে করোনার থাবা। শুধু অঞ্চলের বৈষম্যই নয়, করোনা তুলে দিয়েছে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্যও। এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, রাজপুত্র থেকে শুরু কর খেটে খাওয়া মানুষ- কেউই করোনার থাবা থেকে মুক্ত নন। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভয়ে জবুথবু, ঘরে আটকে রেখেছেন নিজেদের।
বলা হয় বিচ্ছিন্ন থাকা, পরিচ্ছন্ন থাকাই করোনা থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায়। কিন্তু ব্রিটিশ প্রিন্স চার্লস বা ব্রিটিশ বরিস জনসন আক্রান্ত হওয়ার পর আমার সে বিশ্বাসও টলে গেছে। তার মানে রাজপ্রাসাদ বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোনোটাই নিরাপদ নয়। ভয়ে ব্রিটিশ রানিকে রাজপ্রাসাদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে নিরাপদ স্থানে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন বিশ্বে কোথাও নিরাপদ নয়। বিশ্বে এমন কোনো প্রান্ত নেই, যেখানে পয়সাওয়ালারা নিরাপত্তা কিনতে পারবেন। হাজার কোটি সৈন্য বা মিসাইল দিয়েও রুখতে পারবেন না করোনার আগ্রাসন। সমাজতন্ত্র একসময় বিশ্বে সম্পদের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সেটা হয়নি। কিন্তু এত আতঙ্কের মধ্যেও এই অদ্ভূত সাম্যবাদ দেখে কৌতুকবোধ হচ্ছে। যাক অন্তত একটি ভাইরাস গোটা বিশ্বকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পেরেছে।
গোটা বিশ্বেই অভিন্ন অসুখে অভিন্ন চিকিৎসা। সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশেই সেই সাম্যবাদ আটকানোর অপচেষ্টা হয়েছে। তবে সেই অপচেষ্টা আবার রুখেও দিয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র বিরোধী দল ফেসবুক। বাংলাদেশে করোনা প্রস্তুতি যথাযথ ছিল না। মন্ত্রীরা খুব একটা পাত্তা দেননি। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বোধহয় বিষয়টা ভালো করে বোঝেনইনি। করোনার সংক্রমণ শুরুর পরও পেছনে ৩৭ জন নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করে তিনি সেটা প্রমাণও করেছেন। এর আগে ডেঙ্গু মৌসুমে তিনি প্রমোদভ্রমণে গিয়েছিলেন। এবার অবশ্য সেই সুযোগ নেই। তবে প্রতিদিনই বাসা থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে জাতিকে দারুণ বিনোদন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যে তথ্য আইইডিসিআর পরিচালক দিলেই হয়, সেই তথ্য স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী দিচ্ছেন। আমরা ভাগ্যবান বটে।
করোনা যখন ঘাড়ের ওপর, তখনও এর টেস্ট করার মতো কিট ছিল মাত্র দুই হাজার। এই দুই হাজার দিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। শুরুতে আমাদের নীতি ছিল যেন- নো টেস্ট, নো করোনা। পরে আস্তে আস্তে টেস্ট করার সুবিধা বেড়েছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা শুরু থেকেই বলে আসছে, যত বেশি টেস্ট করো এবং শনাক্তদের আলাদা করে ফেলো। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা টেস্টই হলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রথমত আইইডিসিআরের হটলাইনে লাইন পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। আর লাইন পাওয়ার চেয়েও কঠিন সিরিয়াল পাওয়া।
প্রথম কথা হলো, টেস্ট করার আগে আইইডিসিআরের কাছে বিশাল ইন্টারভিউ দিতে হয়। সন্তুষ্ট হলেই কেবল সিরিয়াল। তবে আইইডিসিআরের সিরিয়াল পেতে পেতে অনেকের নাম আজরাইলের সিরিয়ালে উঠে যায়। আইইডিসিআর প্রথমে টেস্ট করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, এমন মানুষেরও করোনা হয়েছে। টেস্ট করাতে পারেননি, এমন অনেকেই করোনা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাতে কমিউনিটি সংক্রমণ দ্রুততর হয়েছে। অথচ চাইলেই শুরু থেকে টেস্ট করার প্রস্তুতি নেয়া যেত। কারণ বাংলাদেশ প্রস্তুতির জন্য অতি মূল্যবান আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। নিজেরা তো করেইনি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা স্বল্প খরচে করোনা টেস্টের একটা পদ্ধতি আবিষ্কারের দাবি করেছিল। সেটা নিয়েও সরকারের প্রবল অনাগ্রহ দেখা গেছে।
শুরুতে প্রস্তুতি না থাকলেও সংক্রমণ শুরুর পর আস্তে আস্তে প্রস্তুতিও শুরু হয়। প্রথমে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল পরে আস্তে আস্তে শুধু করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বাড়ানো হয়। চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু যেহেতু সবার জন্য সমান ব্যবস্থা, তাই আমি আশাবাদী ছিলাম নিজেদের স্বার্থেই কর্তাব্যক্তিরা ব্যবস্থাটি ভালো করবেন। কারণ এই প্রথম অসুস্থ হলেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওড়ার সুযোগ নেই। সবার একই সুবিধা। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? সরকার তাই বিকল্প চিন্তা শুরু করল। করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটকে ভিআইপিদের জন্য আলাদা করার প্রস্তুতি শুরু হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে একাধিক গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়। একইসঙ্গে তিনি জানান, তারা অ্যাপোলো, ইউনাইটেড ও স্কয়ার হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলছেন, যাতে বিত্তশালীদের কেউ আক্রান্ত হলে সেখানে চিকিৎসা পান। ব্যাস, একবার ভিআইপি আর বিত্তশালীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল বানাতে পারলে সাধারণ মানুষের বিষয়টি আর ভাবার দরকার নেই। কুয়েত মৈত্রী আর কুর্মিটোলার যে অবস্থা, তার চেয়ে বাসায় শুয়ে মরে যাওয়া ভালো।
ভিআইপি ও বিত্তশালীদের জন্য আলাদা হাসপাতালের খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের একমাত্র বিরোধী দল ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার আবার বিরোধী দলের মতকে খুব গুরুত্ব দেয়। ফেসবুকে গড়ে ওঠা প্রায় সব ইস্যুতেই সরকার ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছে। আর এই ইস্যুতে সুবিধা ছিল, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই জানাজানি হয়ে যাওয়ায় সরকার অস্বীকার করতে পারবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাই করেছেন। বলেছেন, ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতালের খবরটি সঠিক নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতই অস্বীকার করুন, ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতালের ভাবনাটা তো কেউ না কেউ ভেবেছিল। একজন অতিরিক্ত সচিব তো স্বপ্ন দেখে সাংবাদিকবদের সাথে কথা বলেননি। খবরটি যদি ভুলই হবে, তাহলে সাংবাদিকদের অসত্য তথ্য দেয়ার দায়ে সেই অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? আসল কথাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলেই, ভিআইপি হাসপাতালের আইডিয়া থেকে সরে এসেছেন আমলারা। এখন সবাই অস্বীকার করে পার পেতে চাইছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ১০ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখান। আর তার সরকারের ভেতরে কেউ না কেউ ভিআইপিদের জন্য হাসপাতাল বানানোর পরিকল্পনা করেন। ভাবা যায়! বিষয়টি যেহেতু হচ্ছে না, তাই বিস্তারিত আর বললাম না। খালি একটা কথা বলি, এ ধরনের ভাবনা, এ ধরনের উদ্যোগ সংবিধান পরিপন্থী। যেহেতু ভিআইপি আর বিত্তশালীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল হচ্ছে না, তাই জানা গেল না, বাংলাদেশে ভিআইপি কারা, বিত্তশালী কারা? প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, তাকে যেন কখনো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা না হয়। সেখানে ভিআইপি কারা? ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল না করে চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করেন, যার সুবিধা সবাই পাবেন। করোনা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার ফাঁকিটা উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছে।
চিকিৎসায় বৈষম্যটা ঠেকানো গেলেও মৃত্যুতে বৈষম্যটা ঠেকানো গেল না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনায় আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে ক্ষতিপূরণেও বৈষম্য করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এ-সংক্রান্ত পরিপত্রে বলা হয়, বেতন স্কেল অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ টাকা, মারা গেলে তার পরিবার পাবে ২৫ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা আর মারা গেলে পাবেন ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। হায় রাষ্ট্র, মৃত্যুতেও বৈষম্য গেল না।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। তবে এই পরিপত্র দেখে আমার একটা কৌতুক মনে পড়েছে। একবার এক লোক বাসায় ফিরে স্ত্রী বললেন, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আজ অফিসে আগুন লেগেছিল। বেশ কয়েকজন মারাও গেছে। স্ত্রী বললেন, তুমি কোথায় ছিলে? লোকটা কাচুমাচু করে বলল, একটু সিগারেট খেতে বাইরে গিয়েছিলাম। শুনে তার স্ত্রী একটু কটাক্ষ হানলেও স্বস্তির নিশ্বাসই ফেললেন। এরপর লোকটি বললেন, যারা মারা গেছে, তাদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেয়া হবে। এবার মহিলা ক্ষেপে গেলেন, কত করে বললাম, সিগারেট খেও না, সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর। এবার তো ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হলো।
কৌতুক কৌতুকই। বাংলাদেশে এমন নিষ্ঠুর স্ত্রী একজনও নেই। কিন্তু পরিপত্রের আরেকটা লাইন আমার মনে আরেকটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে- ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস পজিটিভের প্রমাণপত্র বা মেডিকেল রিপোর্টসহ স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। আমার শঙ্কা কদিন পর করোনা পজিটিভের প্রমাণপত্র আবার বিক্রি হবে না তো। যে দেশে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে সচিবরা পর্যন্ত সুবিধা নেন, বাড়তি সময় চাকরি করেন, সে দেশে সবই সম্ভব।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ