ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি থেকেই যায়

প্রকাশিতঃ 10:45 pm | July 22, 2025

মোস্তফা কামাল:

শান্তি-মানবাধিকার সব সময় কেবল সরকারই হনন করে না। রাজনৈতিক দলগুলোও এর অংশীজন। সবারই এতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। যে কারণে সংসদীয় বা প্রেসিডেন্সিয়াল যে কোনো সরকার ব্যবস্থায় উপযুক্ত প্রতিপক্ষ একটি অন্যতম শর্ত। প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দল না থাকলে সরকার দুর্বল হয়, আগ্রাসীও হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়ে ওঠে বেপরোয়া। এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন। ক্ষমতাসীন সরকারটি কারো প্রতিপক্ষ নয়। মাঠে ক্রিয়াশীল সবার পক্ষের সরকার। জাতীয় সরকার না হলেও জাতির সরকার।

ফেব্রুয়ারি বা যে কোনো সময় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে এ সরকার। দেশ চালাবে নির্বাচিত সরকার। সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরে ছায়া হয়ে থাকবে বিরোধীদল। কিন্তু, এখনই আশ্চর্যজনকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর বেদম বিরোধিতা। কে, কেন, কার প্রতিপক্ষ তা অস্পষ্ট। যে, যেভাবে পারছে পরস্পরের গোষ্ঠি উদ্ধার করছে। সাবেকদের নিপাতই নয়, নিজেদেরও রেহাই দিচ্ছে না। লাশও পড়ছে। কেউ দায় নিচ্ছে না।

কারো নিয়তেই শুদ্ধতার নমুনা নেই। অথচ তারা সবাই গেল ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের অংশীজন। তাদের যার যার জায়গা থেকে রাখা ভূমিকার অনবদ্য ফসল চব্বিশের ৫ আগস্ট। যার সুবাদে তারা এখন মুক্ত-শঙ্কামুক্ত। কিন্তু, শব্দ-ভাষা প্রয়োগে তারা যেন জনম-জনমের প্রতিপক্ষ। যা নিয়তির মতো রাজনীতিকে নিচ্ছে হিংসা-প্রতিহিংসার দিকে। নিয়ত-নিয়তির এমন রসায়ন সুন্দর আগামীকে করে তুলছে অনিশ্চিত। তাদের মধ্যে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকার বড়াই চলতে পারতো। কার কতো অবদান ছিল, সেটার জানান দেয়া অযৌক্তিক হতো না। সামনের নির্বাচনে কার কী অ্যাজেন্ডা, তা জানানো যেত। ক্ষমতায় গেলে কে কী করবেন-তাও জানাতে পারতেন। তা না করে তারা পরস্পরকে এমন সব শব্দ-বাক্য মেলানো অভিযোগে ঠেসে ধরছেন, যা ভবিষ্যতে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার আরো কদাকার বার্তা দিচ্ছে। ভাবনমুনা বলছে, নিয়ত বা সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা এসব করছেন।

জনগণ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারকে পরাজিত করে আর পরবর্তী শাসকরা তাদের পথই অনুসরণ করে। এক দখলবাজের পরিবর্তে আরেক দখলবাজ, এক দুর্নীতিবাজের পরিবর্তে আরেক। তাই অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি থেকেই যায়।

বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির সাম্প্রতিক কিছু আচরণ জুলাই-আগস্ট চেতনার সাথে যায় না। এর বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অংশের সহায়তায় কেউ কেউ দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কি না- এ প্রশ্নও উঠেছে। এ সরকারের পক্ষে কি আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব- এ প্রশ্নও বাদ যাচ্ছে না। আশঙ্কা হচ্ছে, রাষ্ট্র নিজ প্রতিক্রিয়ায় সংযম হারিয়ে ফেললে গণতন্ত্রের পথ শুধু কঠিনই নয়, বিপজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে। দেশের প্রধান দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ পর্যন্ত আনা হয়েছে। তাহলে বাকি থাকলো কী? মাঝ বরাবর প্রশ্ন উঠেছে সরকার নিজেই কি গোপালগঞ্জকে গাজা বা কাশ্মীরের মতো বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বানাতে চায়? কোনো প্রশ্নেরই জবাব মিলছে না। নিস্পত্তিহীন আরো নানা প্রশ্নে চরম উদ্বেগে দিন পার করছে সাধারণ মানুষ।

বিএনপি-জামায়াত কেওয়াস উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে। গোপালগঞ্জ অ্যাপিসোডের পর এনসিপির এখন নিয়মিত কাজ বিএনপিকে উত্তেজিত করা। কক্সবাজারের সন্তান সালাহউদ্দিন আহমেদকে তার এলাকায় গিয়ে ভারত থেকে আসা গডফাদার, চাঁদাবাজ, দখলবাজ বলায় বিএনপি এবং এলাকাবাসী এনসিপিকে ধাওয়া করেছে। তফাৎ বলতে গোপালগঞ্জের মতো কক্সবাজারে কারফিউ জারি হয়নি। জুলাই থেকে জুলাই। এক বছরের ব্যবধানে এমন পরিস্থিতি আদৌ কাম্য ছিল না। চব্বিশের জুলাই ছিল সাহসের, প্রতিরোধের। বাংলাদেশের লড়াকু জনগণ যেকোনো অন্যায়, জবরদস্তি, দুঃশাসন মেনে নেয় না, কোনো স্বৈরাচারকেই ক্ষমতায় থাকতে দেয় না, বুকের রক্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, জীবন দিয়ে জীবনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তা নতুন রূপে প্রমাণ করেছে গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে।

টানা ১৫-১৬ বছরের স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার বিরোধী সংগ্রাম যেন কেন্দ্রীভূত হয়েছিল জুলাই মাসে। এ জুলাইতে এসে কী দৃশ্যপট! মৃতরা হারিয়ে গেছে জীবন থেকে আর আহতদের হারিয়ে গেছে জীবনের ছন্দ। মৃত্যু যে রাজনীতির শেষ নয়, তা আবার দেখতে হচ্ছে। জনগণ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারকে পরাজিত করে আর পরবর্তী শাসকরা তাদের পথই অনুসরণ করে। এক দখলবাজের পরিবর্তে আরেক দখলবাজ, এক দুর্নীতিবাজের পরিবর্তে আরেক। তাই অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি থেকেই যায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের আক্রমণাত্মক বক্তব্য আরেকটি আক্রমণাত্মক বক্তব্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। অতীতের এই বেদনাময় অভিজ্ঞতা থেকেই প্রত্যাশা ছিল অভ্যুত্থানের পর পুরোনো পথে যেন ফিরে না যায় দেশ। সেই প্রত্যাশার গুড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। একটা রাজনৈতিক দলের মতবাদ বা আদর্শ কারো কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। তাই বলে সেই আদর্শকে বিনাস- ধ্বংস করার হুমকি! গুঁড়িয়ে দেয়া, পুড়িয়ে দেয়ার নাশকতা। যাচ্ছেতাই ভাষায় ধমকি-ক্ষ্যামটি!

জনতার ওপর নিষ্পেষণ চালিয়ে, ভয় তৈরি করে যে শেষ রক্ষা হয় না, তার আনুষ্ঠানিক প্রমাণের তো এক বছরও পার হয়নি। তাহলে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের রক্ষাকারী বা আশ্রয়ের আর কোনো জায়গা থাকছে না। এখন এই কোটি কোটি জনগণ যদি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাহায্য চায়? বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, শাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সুদান, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, ইউক্রেন, সিরিয়ার পর বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের মিশন চালু হতে যাচ্ছে। এতে শান্তি আসবে? শোধ-প্রতিশোধের মানসিকতা দমন হবে? ফিরবে মানবাধিকার?

ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন খোলার চুক্তি নিয়ে কিছু লুকোচুরি রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের দুর্ভাবনায় ফেলেছে। চুক্তির আগে তাদের সাথে আলোচনার গরজ করেনি সরকার। একটু দেরি করে সরকারের দিক থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বাস্তবতাকে পুরোপুরি সম্মান করে কাজ করার শর্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সাথে তিন বছরের একটি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার। এই সমঝোতার অধীনে জাতিসংঘ একটি মিশন পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।

জাতিসংঘ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বাস্তবতাকে পুরোপুরি সম্মান দেখিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। এই অংশীদারত্ব জাতীয় স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে সরকারের এই চুক্তি থেকে সরে আসার সার্বভৌম অধিকার থাকবে। কথা ঠিক থাকলে আশা করা যায়, মানবাধিকার কার্যালয়ের মিশন থাকলে জাতিসংঘের মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হবে না। একতরফাও হবে না। মানবাধিকার মিশন নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে, সেই প্রত্যাশা রাখতে বাধা নেই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।