মামলায় ‘কাবু’ বিএনপি

প্রকাশিতঃ 5:40 pm | February 23, 2018

পলিটিক্যাল এডিটর, কালের আলো :
মামলার জালে বন্দি হয়ে ঘরে-বাইরে চরম দু:সময় পার করছেন বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা। দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের কারাদন্ড নিয়ে নির্জন কারাগারে দিন-রাত কাটাচ্ছেন দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এসব মামলা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। দলীয় কর্মকান্ডের চেয়ে মামলা মোকাবেলা করতে আইনজীবিদের চেম্বারেই ছুটতে হচ্ছে তাদের। নির্বাচনী প্রচারেও ব্যস্ত হতে পারছেন না তারা।

দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা কত এমন প্রশ্নে সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি দলটির কোন সিনিয়র নেতা বা আইনজীবিই। তবে তাদের ভাষ্যে, সারাদেশে এ মামলার সংখ্যা হবে প্রায় ৫০ হাজার।

এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই ১০ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। আর এসব মামলার আসামি কয়েক লাখের মতো নেতা-কর্মী। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গড়ে প্রায় ২০টি মামলা রয়েছে।

তবে দলীয় আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৫৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে চলা আন্দোলনেও নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া হয়।

দলটির সিনিয়র এক নেতা বলেন, মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের ওয়ান ইলেভেনের জামানা থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ৯ বছরে সবমিলিয়ে সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত মিলিয়ে কমপক্ষে ১০ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় কারাভোগ করা দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কমপক্ষে আরো তিন ডজন মামলা রয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া অন্য মামলাগুলো বিচারাধীন ও তদন্তাধীন রয়েছে। ভুয়া জন্মদিন পালনের মামলায় খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল প্রতিবেদন দাখিল আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে।

একই অবস্থা লন্ডনে পলাতক দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বেলাতেও। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ শতাধিক মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব মামলার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে তাকেও কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ২১ আগস্ট মামলার বিচার কার্য প্রায় শেষ পর্যায়ে। দলটির এ ‘সেকেন্ড ম্যান’র বিরুদ্ধেই অন্তত ৫ টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও রয়েছে ৮৫টি মামলা। আদালতে প্রায় অর্ধেক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কয়েকটি মামলার বিচারকার্যও শুরু হয়েছে। সব মামলাতেই তিনি জামিনে আছেন। এসব মামলায় সপ্তাহে দুইদিন তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ১১ টি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধেও ১৮ টি, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৯৬টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা রয়েছে। বর্তমানে গয়েশ্বর কারাগারে আছেন।

এছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের নামে ২২, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার নামে ১৯ ও সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে ৪৭টি মামলা রয়েছে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ৭টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নামে ৩৭, এজেডএম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ১৫, বরকতউল্লা বুলুর বিরুদ্ধে ৮৮টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামে ১২, শামসুজ্জামান দুদু ২২, শওকত মাহমুদ ৪৫ ও আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও কয়েক ডজন মামলার আসামি।

দলীয় নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, একেতো দলীয় চেয়ারপার্সন কারাগারে রয়েছেন। কবে নাগাদ তাঁর মুক্তি মিলবে সেই নিশ্চয়তাও নেই। এর সঙ্গে মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ডেও সময় দিতে পারছেন না বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা।

দলীয় কর্মকান্ডের চেয়ে মামলা মোকাবেলায় আইনজীবীদের চেম্বারেই বেশি সময় দিতে হচ্ছে তাদের। এর সঙ্গে আবার রয়েছে ধরপাকড়ের ভয় তো আছেই। নির্বাচন এগিয়ে এলেও বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা জনগণের কাছাকাছি যেতে পারছে না। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসবে মামলা সংক্রান্ত ব্যস্ততা আরও বেড়ে যাবে।

দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রতিদিন সকালে যখন দলীয় কর্মকান্ডে নেতাদের ব্যস্ত থাকার কথা তখন দলের সিনিয়র নেতাসহ অনেককেই আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। এসব মামলায় নীতিনির্ধারকসহ অনেক নেতা ধারাবাহিকভাবে কারাভোগ করছেন। ফলে সংগঠন গুছানো যাচ্ছে না আবার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, সরকারি দলসহ অন্যান্য দলের নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তারা দিব্যি চুটিয়ে জনসংযোগ করছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন সংসদের বাইরে থাকা এ দলটির জন্য ভোটের মাঠ মোটেও অনুকূল নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে যা বোঝানো হয় তা এখানে নেই বললেই চলে। বিএনপি’র অনুপস্থিতিতে প্রচারণার ফাঁকা মাঠে চাঙ্গা হয়ে কাজ করছে আ’লীগ।

এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার ভূয়া ও মিথ্যা মামলায় সাজানো ও কাল্পনিক রায়ে আমাদের দলীয় চেয়ারপার্সনকে কারাগারে রেখেছে। তাকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। খালেদা জিয়াকে ছাড়া এদেশের মাটিতে কোন নির্বাচন হবে না।

তিনি বলেন, আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। দলীয় কর্মকান্ড ফেলে নেতা-কর্মীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। মামলা মোকাবেলায় ব্যস্ততার কারণে কোনো সাংগঠনিক কাজ করা যাচ্ছে না। অচিরেই দলীয় চেয়ারপার্সনকে মুক্তি দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।

কালের আলো/পিএ/এএম

আরও পড়ুন : আওয়ামী লীগের ভাবনায় নির্বাচন, গুছানো হচ্ছে সংগঠনও

Print Friendly, PDF & Email