রাজনীতির সদরে-অন্দরে কূটক্যাচাল; সেনাপ্রধানের সেই সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিতে ‘অপরিহার্য’ জাতীয় ঐক্য
প্রকাশিতঃ 10:32 pm | July 15, 2025

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :
চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হতে চলেছে। কিন্তু এরই মধ্যে আবার বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও দলীয় ক্ষমতা এবং অন্যান্য স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য থেকে এই বিভেদচর্চা প্রকট আকার নিয়েছে। নিত্যদিন ব্যাপক কূটক্যাচাল চলছে রাজনীতির সদরে-অন্দরে। পরিণামে তৈরি হচ্ছে গণকলহ ও অস্থিরতা। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক রূপ নিয়েছে প্রকাশ্যে। সামাজিক অস্থিতিশীলতাও মাত্রা নিয়েছে চরম। ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই অভ্যুত্থানের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বরবাদ হচ্ছে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে কিন্তু শত্রুতা কাম্য নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা-ছোড়াছুড়িতে ‘বিরক্ত’ ও ‘দুর্বিষহ’ অবস্থায় ক্ষোভ থেকেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রায় ৫ মাস আগে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ উপলক্ষ্যে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি সব পক্ষকে আগাম সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’ সেদিন তিনি এ-ও বলেন, ‘এই দেশ সবার। আমরা সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি। এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
সব ভেদাভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে একটি নতুন রাজনৈতিক প্রাণপ্রবাহ তৈরিতে এরপর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হয়। কিন্তু সময় গড়াতেই অপরিহার্য জাতীয় ঐক্যের বদলে নানা ঘটনা-ঘনঘটায় পারস্পরিক বাগ্যুদ্ধ, মবক্রেসি, পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই বিভাজনটা আরও বিস্তৃত হয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের তকমার রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্য দিয়ে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়লেও উচ্চ পেশাদারিত্ব, দেশপ্রেম, সততা ও অটুট মনোবল নিয়ে স্বমহিমায় টিকে রয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অলীক স্বপ্নে বিভোর ইউটোবিয়ান ও সো কলড রাজনীতিকরা তাদের টার্গেট করে অটল মনোবলে চিড় ধরাতে বাহিনীপ্রধান বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর চরিত্রহননের অপপ্রয়াস চালায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসীম ধৈর্য্য ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গেই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন সেনাপ্রধান। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে গোয়েবলসীয় থিওরিতে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও এনএসআইকেও নানা কূটকৌশলে লক্ষ্যবস্তু করে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু ‘সবার আগে দেশ’ এই নীতিতে বিশ্বাসী গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি গোয়েন্দা সংস্থা কোন ফাঁদে পা না দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। রাওয়ার সেই অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান নিজেও বলেছিলেন- ‘পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে অতীতে। খারাপ কাজের সাথে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। এর মধ্যে যদি অপরাধ করে থাকে, সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজটা করব, এই সমস্ত অর্গানাইজেশনগুলো যেন আন্ডারমাইন না হয়।’ দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনী পঞ্চম দফায় ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে এই সময়টিতে অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়েই কাজ করেছে অহর্নিশ। কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বাড়তি বল প্রয়োগের নজির নেই। কিন্তু কাজের কাজ ঠিকই করে চলেছেন দৃঢ় ও নির্ভীক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
দুনিয়া কাঁপানো চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। ভবিষ্যতের রাজনীতির বাঁকবদলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ১১ মাসের মাথায় এসে সেটা বড় এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে বিরোধ-অনৈক্য মাথাচাড়া দিচ্ছে। এরই মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড শোকস্তব্ধ করে দেয় গোটা দেশকে। বিচারের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর সবার মুখে প্রশ্ন কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড? এর কারণই বা কী? কীভাবে ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবদলের ৫ নেতাকর্মীকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিস্কার করা হয়। বিএনপি’র হাইকমাণ্ড শুধু এই ঘটনায় নয় গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ অথবা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঘটনায় কাউকেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সঙ্গে সঙ্গেই জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তারেক রহমান ও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে যে পথ বেছে নেওয়া হয়েছে সেটি বিস্ময়ে হতবাক করেছে দেশবাসীকে।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং ইডেন মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নামে অনুষ্ঠিত মিছিলে উচ্চারিত নানা অশ্লীল, আপত্তিকর ও অশোভন ভাষার স্লোগান নজরে এসেছে সবার। এসব মিছিলের স্লোগানে বিএনপিকে বিশেষ করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নির্লজ্জ কায়দায় আক্রমণ করা হয়। স্লোগানের এমন ভাষা নিয়ে যেমন একদিকে বিতর্ক এবং সমালোচনা চলছে; অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ইতিবাচক ভাবমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতেই এসব মিছিলের আয়োজন কি না, এমন প্রশ্নও উঠেছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। বিএনপির নেতারা এ ঘটনাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখছেন। বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ’ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার কসরতও চলেছে সমানতালে। সামগ্রিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে দৃঢ় ঐক্য থাকা দরকার ছিল তাঁর বিপরীতে একে-অপরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দূরত্ব বাড়ছে ক্রমশ।
বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির পাল্টাপাল্টি অবস্থান বা বিরোধ প্রকাশ্যে আসায় দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একক কোনো শক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ছিল না। ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। পেছনে থেকে তারাই হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করেছে। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী যখন পতিত সরকারের নির্দেশ অমান্য করে ‘আমরা ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালাবো না’-এমন ঘোষণা দেয় ঠিক তখনই হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন এর ছাত্র-জনতার পক্ষে এমন শক্ত অবস্থান জাতিকে সেদিন একটি রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দেয়। তিন বাহিনী প্রধান রক্তপাত এড়িয়ে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানের পথনকশা প্রস্তুত করেন। তাঁরা ইচ্ছা করলেই ক্ষমতাকে আলিঙ্গন করতে পারতেন অনায়েসেই। সেই সুযোগও ছিল। কিন্তু তাঁরা সে পথে হাঁটেননি। তাদের এই যুথবদ্ধ প্রয়াস ইতিহাস অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে। দেশের মানুষ এখনও তিন বাহিনী প্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্বের প্রশংসা করছেন। তাঁরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও টালমাটাল অবস্থা থেকে ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতায় দেশের জনগণের পাশে থেকে অন্ধকার এক টানেল থেকে আলোর রেখা দেখিয়েছেন দেশের মানুষকে।
রাওয়ার অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশার বিষয়টি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেছিলেন। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে সত্যিকার অর্থেই বিভেদ ভুলে কী কাজ করতে পেরেছে সেই প্রশ্নই সামনে এসেছে বারবার। নিজেদের মধ্যে সমস্যা থাকতে পারে; কিন্তু কোনো ক্ষোভ-অভিযোগ থেকে থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করাটা যৌক্তিক। ভুলে গেলে চলবে না, সবার উপরে দেশ। দেশের কল্যাণ ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সর্বাধিক বিবেচনায় রেখে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে বিভেদ ভুলে, পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে কাজ করে যেতে হবে। দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পেছনে নানা পক্ষের বিভেদ, হানাহানির দায় যে রয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, চিন্তা-চেতনার বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু দিনশেষে সবাই দেশ ও জাতির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেন এক থাকতে পারি। তাহলেই এই দেশ উন্নত হবে, সঠিক পথে পরিচালিত হবে।
দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীসহ যেসব সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, কিছু সদস্যের কারণে তাদের প্রতি অভিযোগের তির ছোড়ার চিরায়ত সংস্কৃতি থেকে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই বের হয়ে আসতে হবে। যারা অপরাধী, তাদের জন্য দেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচারের পথ খোলা রয়েছে, বিচার প্রক্রিয়া রয়েছে। আমরা সবাই সেই ব্যাপারে এখনও শ্রদ্ধাশীল না হলে তাদের কার্যক্রমে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তার জের সবাইকেই টানতে হবে। কাজেই সব ভেদাভেদ ভুলে দেশে একটি প্রশ্নমুক্ত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সেনাপ্রধানের ৫ মাস আগের দেওয়া বক্তব্য যেমন ওই সময় জনমনে ভাবনার উর্দ্রকে ঘটিয়েছিল তেমনি বর্তমান কঠিন বাস্তবতায় এটি রাজনীতিকদের জন্য একটি বার্তা। সবার জন্যই সতর্কবার্তা। এখনও যদি রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার অঙ্গীকারের প্রতি শৈথিল্য দেখান সেটা উদ্বেগজনক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে দেশকে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর টনক থাকলে নড়া উচিত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কালের আলো/এমএএএম