দেশের জলসীমার সুরক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করলো ‘বানৌজা বিশখালী’, সক্ষমতার ‘মাইলফলক’ হিসেবেই দেখছেন নৌবাহিনী প্রধান
প্রকাশিতঃ 10:01 pm | November 30, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
লম্বা এক সাইরেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে নিজের আগমনী বার্তার জানান দিলো ‘বানৌজা বিশখালী’ নামে নতুন একটি যুদ্ধজাহাজ। আনুষ্ঠানিকভাবে বাজলো ঘণ্টা, উড়লো বেলুন। নৌবাহিনীর নৌবহরে যুক্ত এই জাহাজটি তৈরি হয়েছে দেশীয় প্রযুক্তিতে। শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে খুলনার নৌবাহিনীর তিতুমীর ঘাঁটির নেভাল বার্থে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশনিং করা হয় এই যুদ্ধজাহাজের। বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান নামফলক উন্মোচনের পর জাহাজটির অধিনায়কের কাছে কমিশনিং ফরমান তুলে দেন। এর মধ্যে দিয়ে দেশের জলসীমা সুরক্ষায় যুক্ত হলো নতুন মাত্রা। দেশের সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার স্বার্থে বানানো যুদ্ধজাহাজটির মাধ্যমে আধুনিক, শক্তিশালী ও সক্ষম নৌবাহিনী এগিয়ে গেলো আরও এক ধাপ। নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রায় সূচিত হলো নতুন এক অধ্যায়ের। দেশের জন্য গৌরবময় এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে গর্বিত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীরাও।
খুলনা শিপইয়ার্ডে দেশীয় প্রযুক্তিতে জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে এই খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত জাহাজ ‘বানৌজা বিশখালী’কে নৌবাহিনীর সক্ষমতার আরও একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। তিনি মনে করেন, নৌবহরে সক্ষমতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ এক সুদক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ‘বানৌজা বিশখালী’তে রয়েছে একটি ৪০ মিলিমিটার বাফার গান, দুইটি ১২ দশমিক ৭ মিলিমিটার হেভি মেশিন গান, মাইন লেইং রেল, অত্যাধুনিক সারভাইলেন্স র্যাডার, জিপিএস, ইকো-সাউন্ডার সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম। বিশখালী নদীর নামে নির্মিত জাহাজটি ১৯৭৮ সালে নৌবাহিনীতে কমিশনিং করা হয়। এরপর থেকে সকল অপারেশনাল কর্মকাণ্ডে সফলতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। দীর্ঘ ৩৬ বছর দেশের জলসীমার সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকার পর জাহাজটি ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে ডি-কমিশন করা হয়। পরবর্তীতে খুলনা শিপইয়ার্ডে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর নতুন করে জাহাজটি নির্মাণের লক্ষ্যে কিল লেয়িং করা হয়।
৪১তম পেট্রোল ক্রাফট স্কোয়াড্রন এর পঞ্চম জাহাজ ‘বানৌজা বিশখালী’ নির্মাণ শেষে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর নৌবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে নব সংযোজিত জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৫১ দশমিক ৬ মিটার এবং প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ মিটার। জাহাজটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে সক্ষম বলে জানিয়েছে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এর আগে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান খুলনার নৌবাহিনীর তিতুমীর ঘাঁটির নেভাল বার্থে এসে পৌঁছলে খুলনা নৌ অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল গোলাম সাদেক তাঁকে স্বাগত জানান। এ সময় নৌবাহিনীর একটি চৌকস দল নৌবাহিনী প্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
- নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রায় সূচিত নতুন এক অধ্যায়ের
- আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ‘বানৌজা বিশখালী’তে রয়েছে একটি ৪০ মিলিমিটার বাফার গান, দুইটি ১২ দশমিক ৭ মিলিমিটার হেভি মেশিন গানসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম
- জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নৌবাহিনী সর্বদা নিয়োজিত
জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নৌবহরে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় দেশের তৈরি দুটি সর্ববৃহৎ যুদ্ধজাহাজ। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো নৌবহরে যুক্ত হয়েছে দুটি সাবমেরিন টাগ (সাবমেরিনকে সহায়তাকারী জাহাজ)। ‘দুর্গম’ ও ‘নিশান’ নামের জাহাজ দুটি এবং ‘হালদা’ ও ‘পশুর’ নামের টাগ দুটি তৈরি করে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড। প্রায় ৬৭ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই শিপইয়ার্ড আশির দশকের দিকে লোকসানের মুখে পড়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে সরকার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে মৃতপ্রায় ওই প্রতিষ্ঠানটি হস্তান্তর করেন। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে ইয়ার্ডটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাঁরাই প্রথম নৌবাহিনীর জন্য প্রথম যুদ্ধ জাহাজ তৈরির সফলতা দেখিয়েছে, বিশ্বকে জানান দেয় ‘আমরা পারি’।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নৌবাহিনী সর্বদা নিয়োজিত
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, ‘লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বোপরি ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দেশে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় চলমান অপারেশনে এবং সাম্প্রতিক বন্যায় এবং বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আপনারা যেভাবে দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও গৌরবের। এছাড়া দেশের বিস্তৃত সমুদ্র এলাকায় সার্বভৌমত্ব ও সমুদ্র সম্পদের সুরক্ষা ও জাতীয় মাছ ইলিশসহ মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা, বাণিজ্যিক জাহাজ, সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা বিধানসহ জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নৌবাহিনী সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিটি সদস্য তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও উদ্ভাবনী মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নৌবাহিনীকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের প্রয়োজনে এবং জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসেবে নৌবাহিনীর সদস্যগণ সেনা ও বিমানবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যতদিন প্রয়োজন এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
নৌ সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে আধুনিক নৌবাহিনী
দীর্ঘ ৫৩ বছরে নৌ সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম, আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার বিনিময়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি আধুনিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নৌবাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, ‘নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফ্রিগেট, কর্ভেট, লার্জ পেট্রোল ক্রাফট, মিডিয়াম পেট্রোল ক্রাফট এবং অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজ। এছাড়া নৌবহরে হেলিকপ্টার, টহল বিমান ও সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে স্পেশাল ফোর্স সোয়াডস। সমুদ্রে নজরদারি বৃদ্ধি ও টহল জোরদারকরণের লক্ষ্যে হেলিকপ্টার এবং ড্রোনসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয় ও নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সাবমেরিন অপারেশন ও প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক পরিসীমায় দেশের সুনাম সমুজ্জ্বল করে চলেছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ কুয়েত এবং কাতারে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা নৌবাহিনীর সদস্যগণ পেশাগত দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে সুখ্যাতি অর্জন করে চলেছে। আমাদের যুদ্ধ জাহাজ ভূমধ্যসাগরে মাল্টি ন্যাশনাল মেরিটাইম টাস্কফোর্স এর অধীনে নিয়োজিত থেকে সারা বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। নৌবাহিনীতে যুক্ত হতে যাচ্ছে খুলনা শিপইয়ার্ডে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আরও একটি যুদ্ধজাহাজ ‘বানৌজা বিশখালী’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ‘বানৌজা বিশখালী’ নৌবাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজের ন্যায় এদেশের নদী ও সমুদ্রসীমায় চোরাচালান প্রতিরোধ, উপকূলীয় এলাকায় টহল প্রদান, অবৈধ মৎস্য আহরণ প্রতিরোধ, বাণিজ্যিক জাহাজকে জলদস্যুর কবল থেকে নিরাপত্তা প্রদানসহ সকল অপারেশনাল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে দেশ সেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।’
- নৌ সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে আধুনিক নৌবাহিনী
- সুনীল অর্থনীতির বিশাল কর্মযজ্ঞে নিরাপত্তা প্রদান ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে নৌবাহিনী
সুনীল অর্থনীতির বিশাল কর্মযজ্ঞে নিরাপত্তা প্রদান ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে নৌবাহিনী
প্রায় এক যুগ আগে খুলনা শিপইয়ার্ডে যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আমি নিশ্চিত আমাদের নিজস্ব শিপইয়ার্ডে যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে একদিকে যেমন অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়সহ বাংলাদেশ নৌবাহিনী বায়ার নেভি থেকে বিল্ডার্স নেভিতে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছে’- বলেন নৌবাহিনী প্রধান। এডমিরাল এম নাজমুল হাসান আরও বলেন, ‘বছরজুড়ে সারা দেশে নদীপথে ও সমুদ্রে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় জানমালের সুরক্ষায় নৌবাহিনীর ডাইভিং ও স্যালভেজ টিমের সদস্যগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সমুদ্র ও নদীপথে অগ্নিনির্বাপণেও নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা সদা তৎপর এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা সকলেই জানেন আমাদের বিশাল সমুদ্র ও উপকূলবর্তী এলাকায় ব্লু ইকোনমির কর্মকাণ্ড বর্তমানে চলমান রয়েছে। এই ব্লু ইকোনমি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। ব্লু ইকোনমি বিষয়ক সকল কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আমাদের সমুদ্রসীমায় সার্বক্ষণিক টহল জারি রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দর এবং নবনির্মিত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ নৌবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যা এই বাহিনী সফলতার সঙ্গে পালন করে চলেছে। সুনীল অর্থনীতির এসব বিশাল কর্মযজ্ঞে নিরাপত্তা প্রদানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাঁর চলমান কার্যক্রম এবং ভূমিকা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে।’
কালের আলো/এমএএএমকে