ড.ইউনূস ম্যাজিকে দেশে ফেরা সেই ৫৭ বাংলাদেশী আপ্লুত-কৃতজ্ঞ

প্রকাশিতঃ 9:52 pm | September 13, 2024

কালের আলো রিপোর্ট :

রীতিমতো এক অসাধ্য সাধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতায় ক্ষমা পেয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করে সাজা পাওয়া ৫৭ বাংলাদেশি। ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ করে সাজা পেয়েছিলেন তাঁরা। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই প্রবাসীদের ক্ষমা করে দেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। এ যেন এক ম্যাজিক!

এরপর থেকেই তাদের দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে তিন দফায় ৩১ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছিলেন। অবশিষ্ট ২৬ জন শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ফিরেছেন দেশে। দেশে ফিরে যেন নতুন জীবন পেয়েছেন। স্বজনের সান্নিধ্যে এসে স্বভাবতই আবেগাপ্লুত এই প্রবাসীরা। তাদের কথায় কেবলই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের প্রশংসা। তাঁরা মনে করেন, হতভাগ্য এই প্রবাসীদের ‘স্পন্দন বোঝার’ চেষ্টা করেছেন সরকারপ্রধান। উত্তীর্ণ হয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জে। দেশের পুনর্জন্ম ও পুনরারম্ভে ড.ইউনূসের কুশলী কূটনীতির পাশাপাশি প্রবাসীদের মঙ্গল কামনায় তাঁর উদারতা, বিনয় ও আন্তরিকতা প্রজ্জ্বলিত করেছে সতের কোটির বাংলাদেশীর হৃদয়-মনকেও।

চট্টগ্রামের রাউজানের মধ্যম কদলপুর এলাকার মোহাম্মদ কাউছার উদ্দিনের মা রশিদা বেগম বলছিলেন ঠিক তেমনই- ‘যখন শুনেছি, ছেলে আমার জেলে; তখন থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। ড.ইউনূস স্যার উদ্যোগ না নিলে হয়ত এই জীবনে আর ছেলের দেখা পেতাম না। এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মহান আল্লাহ’র দরবারে তাঁর জন্য প্রার্থনা করি।’

অন্তর্বর্তী সরকার দণ্ড মওকুফের উদ্যোগ নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানান ক্ষমা পাওয়া আরেক বাংলাদেশী সাইদুল হকও। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে আর মুক্তি মিলবে না। কিন্তু সরকার উদ্যোগ নেওয়ায় মুক্ত হয়েছি। চাকরি গেলেও অন্তত পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হতে পারছি। আমরা সৌভাগ্যবান এমন একজন সরকারপ্রধান পেয়েছি।’

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চৌদ্দগ্রাম পৌর সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আলী আহমেদের ছেলে ফরিদ আহমেদ শাহীন নিজেও আমিরাত থেকে কারামুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে আরব আমিরাতের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসা ১৪ বাংলাদেশির একজন তিনি। বিদেশের কারাগার জীবনের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তাড়া করে তাকে। অশ্রুসিক্ত ফরিদ বলেন, ‘ভেবেছিলাম, জীবনে আর দেশে ফিরতে পারব না, পরিবারের সাথে কখনও দেখা হবে না। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউনূস স্যারের (ড. মুহাম্মদ ইউনুস) প্রচেষ্টায় আমরা জেল মুক্ত হয়ে বর্তমানে দেশে আছি। তিনি না থাকলে হয়তো কোনোদিন দেশে আসা হতো না। স্যারের প্রতি আমাদের রক্ত ঋণ।’

জানা যায়, গত জুলাই মাসে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে বাংলাদেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, সে সময় তাতে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছিলেন বাংলাদেশিরা। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় দুবাই, শারজাহ ও আজমানের বিভিন্ন এলাকার সড়কে বিক্ষোভের সময় ৫৭ বাংলাদেশিকে আটক করে আমিরাতের পুলিশ। দু-দিন পর দাঙ্গা, যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং সম্পদহানীর মত অভিযোগে তাদের তিনজনকে যাবজ্জীবন, একজনকে ১১ বছর এবং বাকি ৫৩ জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় স্থানীয় আদালত। এরপর বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সুবিধা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার ঘোষণা দেয় আমিরাত সরকার। কিন্তু আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে ড.ইউনূসের অনুরোধে বদলে যায় দৃশ্যপট। ক্ষমা মেলে সেই ৫৭ বাংলাদেশির। একে একে ফিরে আসেন দেশে।

বিমানবন্দরে আগত প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বাগত জানাতে ভিড় করেন স্বজন ও উৎসুক জনতা। এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও তানভীর ফিরে আসা প্রবাসীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রবাসীরা। এসময় তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

এ ঘটনায় আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চিঠি পাঠান ড. মুহাম্মদ ইউনুস। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক ছাত্র-গণবিপ্লবের সাথে একাত্মতা প্রকাশকারী ৫৭ জন বাংলাদেশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ করেছেন। তাদেরকে ক্ষমা করার আপনার উদার সিদ্ধান্তের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ আমি উপভোগ করছি। আমাদের টেলিফোন কথোপকথনের পর এই ক্ষমাশীলতার কাজটি শুধু সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের উদাহরণই দেয় না বরং আমাদের দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের স্থায়ী বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি বাহক হিসেবে কাজ করে।’

দেশে ফেরত আসা কর্মীদের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের মাধ্যমে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম থেকে পরিবহন খরচসহ জরুরি প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি জানান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও ব্র্যাক এ প্রবাসীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনঃএকত্রীকরণে কাজ করবে। এজন্য তাদের চাহিদা নিরূপণ করে প্রয়োজন অনুযায়ী মনো-সামাজিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা করা হবে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ক্ষতবিক্ষত দেশের হাল ধরেছেন। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বগুণে আরব আমিরাতের ৫৭ বাংলাদেশীকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে এনে বিশ্বপরিমণ্ডলে তাঁর নন্দিত ভাবমূর্তিকে পুনরায় মোটা দাগে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন দেশের মানুষের।’ ‘একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সত্যিই তাঁর প্রতি ভরসা রাখা যায়। সমগ্র জাতিকে তিনি নজিরবিহীন সঙ্কট থেকে বের করে একতাবদ্ধ করেছেন। বিশ্ব কূটনীতিতে মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন’-যোগ করেন বিশ্লেষকরা।

কালের আলো/এমএএএমকে