মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অভিযোগ প্রমাণের পাল্টা চ্যালেঞ্জ সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ’র

প্রকাশিতঃ 8:44 pm | May 21, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদ’র যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সরকারি দলের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এ নিয়ে কথা বলেছেন। কোন মন্তব্য করতে চাননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান। দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তিনি অবাক হয়েছেন। বিষয়টিকে অপ্রত্যাশিত দাবি করে দুটি অভিযোগই তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে অভিযোগ প্রমাণের পাল্টা চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন ‘আমি ডিজি বিজিবি বা সেনাপ্রধান হিসেবে এমন কিছু করিনি যে কারণে আমাকে অনুশোচনা করতে হবে। তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয় না।’

মঙ্গলবার (২১ মে) দুপুরে কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় এমনটিই বলেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। নিজের চাকরি জীবনে নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এ চার তারকা জেনারেল অবসর জীবনেও পশ্চিমাদের রোষানলে পড়েছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এ ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন বলে মনে করছেন সাবেক এ সেনাপ্রধানের শুভাকাঙ্খীরা। বিশেষ করে, সাবেক এ সেনাপ্রধান এখন কোন দায়িত্বে নেই। তাকে টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্র এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিষয়টি এমন নয়, বরং এর পেছনে অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে এটি পরিষ্কার।

এর আগে গত সোমবার (২০ মে) রাতে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এমনটি জানানো হয়। এই তালিকায় তাঁর পরিবারের সদস্যরাও আছেন।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদ, পূর্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান, এর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করতে ভূমিকা রেখেছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আজিজ আহমেদ তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহিতা এড়াতে সাহায্য করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি সরকারি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন। এছাড়া অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। একইসঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেছিলেন।

ভাইয়েরা কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করেননি
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নিজের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদ বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলছি আমার ভাইদের কোন কন্ট্রাক দেইনি। আমার ভাইয়েরা কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করেননি। তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। কেউ এসে বলুক আপনার এই ভাইকে এই কন্ট্রাক দিয়েছেন, তারা দেখাক। আমার যে ভাইয়ের কথা বলা হচ্ছে সেই ভাই ২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ছিল না। আমি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বিজিবিতে ছিলাম। তার আরও আগে আমার ভাই বিদেশে চলে গেছে। সেই হিসেবে আমি আমার পদ পদবী ব্যবহার করে কীভাবে তাকে সহযোগিতা করেছি তা আমার বোধগম্য নয়।’

তিনি দাবি করেন, কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র কীসের ভিত্তিতে কোন অভিযোগে আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি বা অন্য কোনো প্রতিক্রিয়ায় না যাওয়ার কথাও জানান সাবেক এ সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এগুলো সত্য নয়। তাই এর প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না।’

আজিজ আহমেদ যোগ করে বলেন, ‘আমি বিজিবির মহাপরিচালক এবং সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাই বা নিকটাত্মীয় এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোথাও ঠিকাদারি করেছে তার তথ্য প্রমাণ দিতে পারলে আমি সব মেনে নেব। শুধু তাই নয়, এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে তাদের কোনো ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল সেটার প্রমাণ দিতে পারলেও আমি সব শাস্তি মেনে নেব।’

আল জাজিরার মঞ্চস্থ নাটকের সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞা ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত
সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আল জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। তার সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞা ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। অভিযোগ দুইটা একই, কিন্তু এখানে বিস্তারিত বলা হয়নি।

প্রথম অভিযোগ হলো, আমি আমার ভাইকে বাংলাদেশের যে আইন আছে, অপরাধ কর্মকাণ্ড সে যেন এড়িয়ে চলতে পারে; সেজন্য আমি আমার পদ-পদবি ব্যবহার করে তাকে সহযোগিতা করে করাপশন করেছি। এর উত্তর হলো, আমার সেই ভাই আমি জেনারেল হওয়ার অনেক আগেই বিদেশে গেছে। সে নিশ্চয়ই বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে। তার চলে যাওয়া বা দেশের প্রচলিত আইন ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে আমি আমার পদ-পদবি ব্যবহার করেছি- এই অভিযোগটা আমি মেনে নিচ্ছি না। মেনে নিতে পারি না, এটা সঠিক নয়।

তিনি বলেন, আমাকে যে দুই কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার কি কোনো ভিত্তি আছে? তারা বলেছে, আমি আমার পদ-পদবি দিয়ে আমার ভাইকে সহযোগিতা করেছি। আমি কোনো অপরাধ করিনি যে শাস্তি পেতে হবে। তারা আমার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ তুলেছে তার কোনো প্রমাণ থাকলে আমাকে দিক।’

নিষেধাজ্ঞার পেছনের উদ্দেশ্য
জেনারেল আজিজ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার করণীয় কী আর হবে! অনেক সাংবাদিক ভাই এসেছিলেন, জানতে চেয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছি। আমি আমার বক্তব্য সবাইকে জানিয়েছি। এটাই করণীয়। তারা যদি ব্যক্তি আজিজকে টার্গেট করে থাকে, ভেরি আনফরচুনেট। বিশ্বের এক নম্বর দেশ! তাও একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা! অবসরে যাওয়ার তিন বছর পর এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনও রাজনীতিতে নাই, কোনও কিছুতেই নাই। এমন একজনকে নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তে আমি বিস্মিত ও অবাক হয়েছি। এটা হচ্ছে এক ধরনের কথা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তো লাভ নাই। এটার কোনও ফলাফল নাই। এইযে সবাইকে জানানো, এটাই হচ্ছে কথা। আর আমিও তো কাউকে বলিনি যে কথা বলবো না।’

এই নিষেধাজ্ঞার পেছনের উদ্দেশ্যটা কী জানতে চাইলে জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদও নই। কোনও এনালিস্টও নই যে এনালাইসিস করে বলবো। আমি রিটায়ার্ড পারসন। বাট ভেরি আনফরচুনেটলি এটা করা হয়েছে।’

সরকারকে হেয় করার জন্য কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হতেও পারে। যেহেতু আমি এখন কোথাও নাই। সেজন্য অন্য কাউকে এটাতে যুক্ত করতে চাচ্ছি না। এটা সবাই বুঝতে পারবে। সচেতন যে কেউ বুঝতে পারবে কাকে টার্গেট করে কী জন্য এটা করা হয়েছে।’

কী বলছেন মন্ত্রীরা?
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এটা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কেন এই নিষেধাজ্ঞা আসছে, সেটা আমার কাছে এখনো আসেনি। আমি কেবল একটি বিজ্ঞপ্তির কথা শুনেছি। এটা বিস্তারিতভাবে না জেনে প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।’ মঙ্গলবার (২১ মে) সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মার্কিন সরকার অনেক দেশের অনেক ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা তাদের জন্য নতুন কিছু না। আমাদের দেশে যাকে দেওয়া হয়েছে, আমাদের কাছে এখনো সেটা সঠিকভাবে আসেনি। এলে পরে জানতে পারব, কেন দেওয়া হয়েছে।’

তবে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনকে যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়েছিল বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

মঙ্গলবার (২১ মে) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান। ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ নামের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিলো, সেটা ছিলো থ্রি সির আওতায়। আর জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ফরেন অফিস অপরেশন অ্যাক্টের আওতায়। এই দুটি আলাদা বিষয়। তবে আমরা সব সময়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স।

তিনি জানান, এ বিষয়ে আমাদের মিশনকে (ওয়াশিংটন) আগেই জানানো হয়েছিলো। এটা সেনাবাহিনীর বিষয়। এই মূহূর্তে আর কিছু বলতে চাই না। তবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত আছি।’

তবে আজিজ আহমেদ জানিয়েছেন, তাকে এ বিষয়ে কোন কিছুই জানানো হয়নি। তিনি এক বন্ধুর কাছ থেকে সোমবার (২০ মে) রাতে চিঠিটি পেয়েছেন।

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নয় বরং অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন (ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১সি ধারা) আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

মঙ্গলবার (২১ মে) বিকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেটা বলেছে, বাংলাদেশের মিশনকে জেনারেল আজিজের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। জেনারেল আজিজের বিষয়ে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটা ভিসানীতির প্রয়োগ নয়, এটি অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন আইনের প্রয়োগ। এটা নিয়ে আমি আর কিছু বলবো না। এ নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও কথা বলেছেন। আমরা এতটুকুই জানি, এটুকুই বললাম।

কালের আলো/এমকে/আরআই