বিপদ সবার

প্রকাশিতঃ 10:08 am | March 11, 2023

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

‘আড়াই মাস আগে বিয়ে করেছিলেন মো. রবিন হোসেন। তবে নববধূ জিয়াসমিন আক্তারকে নিজ বাড়িতে নেননি। কথা ছিল, আগামী ঈদুল ফিতরের পর ধুমধাম আয়োজনে নববধূকে ঘরে তুলবেন। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের শিকার রবিন নিজেই ফিরছেন লাশ হয়ে’।

একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টের কিছু অংশ এটি। কত সংবেদনশীল হৃদয়কে স্পর্শ করেবে এই রিপোর্ট। কিন্তু নীতিনির্ধারণী জায়গায় যারা বসে আছেন তারা সব অভ্যস্ত এমন মৃত্যুতে। তাদের কাছে ‘নাগরিকের প্রাণের আবার মূল্য কী”?

একের পর এক বিস্ফোরণ। প্রথমে চট্টগ্রামে, এরপর ঢাকায়। কিন্তু কি এসে যায়? চট্টগ্রামে সীমা অক্সিজেন কারখানায় মৃত্যুর আর আহাজারির রেশ না কাটতেই রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে একটি মাঝারি উচ্চতার ভবনে বিস্ফোরণ এবং গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে এর চেয়ে উঁচু ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ।

এসব বিস্ফোরণ বা আগুনে আসলে কী হয়? কিছু অতি সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে, কিছু মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়, কিছু পরিবার আজীবনের জন্য সর্বস্বান্ত হয়। যারা সমাজ চালায়, দেশ চালায়, দেশের মানুষের করের টাকায় আরাম আয়েশে জীবন কাটায়, তাদের তো আসলে কিছু হয় না। তাই দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়রকে ঘটনাস্থলেও দেখা যায় না।

দুই একজন কর্তা ব্যক্তি আসেন, বলেন ‘অত্যন্ত দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, আমরা সব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছি, কীভাবে এই ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা যায় তার ব্যবস্থা করছি’। দুই একদিন পর সব ভুলে যাওয়া হবে। তারচেয়ে বেশি দোষারোপের পালা শুরু হবে, যে পালার রাজনৈতিক বিভাজন অমোঘ, অনিবার্য। এবং আমাদের মানুষ জানে, ভবিষ্যতেও যদি এমন ঘটনা আবার ঘটে, আবারও একই গান বাজবে। সবাই জানে, এই নেতা বা নেত্রী, বা প্রশাসনের লোকজন আসলে মানুষের জন্য নন। তারা আরও উঁচু স্তরের বাসিন্দা এবং মানুষের জীবনের চেয়েও উঁচু ভাবনা তাদের আছে।

আগুন লাগা, বিস্ফোরণ ঘটা, ভবন ধসে পড়া, ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে পড়া– কতকিছুই না ঘটে। তাতে রাষ্ট্রের কী আসে যায়? কার্যত প্রতি বছর দেশের নানা স্থানে এমন দুর্ঘটনার কাহিনী রচিত হয়ে চলে। প্রশাসনের চেতনা উদ্রেকের জন্য আরো কত হাজার মৃত্যু দরকার সেটাও একটা অতি বড় জিজ্ঞাসা।

এসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলবার কোনো অর্থই হয় না। এদেশে যেভাবে নিয়ম না মেনে উঁচু উঁচু ভবন নির্মিত হয়, যেনতেনভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন টানা হয় সেটা এক বিশাল দুর্নীতি। এসব ভবন কখনো পরিদর্শন করা হয় না, এবং এসব ভবনের ব্যবহারকারীরাও প্রয়োজন বোধ করেন না যে বিষয়গুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করা দরকার। এই যে সব বিষয়ে এমন শিথিলতা থাকে, তাতে এমন প্রাণঘাতী বিশৃঙ্খলা যে আরো অনেক হয় না, তাই বরং অতি বিস্ময়কর দুর্ঘটনা। আমরা হয়তো বলব, বিস্ময়ের কিছু নেই, সবই বিধাতার খেলা।

পর পর বিস্ফোরণ ঘটায় একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দানা বেঁধেছে। কিন্তু আমরা যদি একটু সুস্থভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখব আগুন, বিস্ফোরণ আর মৃত্যুর আয়োজন সর্বত্র। একটা ভবন তৈরি হয় বিল্ডিং কোড না মেনে, তার গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তদারকি হয় না, ফায়ার সেফটি পদ্ধতি মানা হয় না।

দাহ্য পদার্থ নিয়ে যারা শিল্প বাণিজ্য চালান, তাদের তো আরো বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। এখানে না আছে কর্তৃপক্ষের তদারকি, না আছে নাগরিক সচেতনতা। ফলে বাস্তবতা হলো মানুষের মৃত্যু, একেকটা পরিবারের স্বপ্নের মৃত্যু।

প্রশাসনকে যদি ভাবতে হয়, সমস্যার মূলে গিয়ে ভাবতে হবে তাহলে সে ভাবুক। যে কোন স্থানে যে কোন পরিসরে যে কোন স্থাপনা নির্মাণ চলবে কিনা, তা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতে হবে। আমরা জানি এরকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবার কাজটি সহজ নয় এবং সেকথা বলে দেবার প্রয়োজনও হয় না। কারণ, এদেশে যারা ভবন নির্মাণের ব্যবসা করে আর যারা নিয়ম আর বিধি বাস্তবায়ন করে তারা ক্ষমতা কাঠামোর মানুষ। সব অনিয়মই তাদের কাছে নিয়ম।

কিন্তু নিয়ম তো মানুষেরই স্বার্থে। এবং সাধারণ স্বার্থ নয়, তা একেবারে জীবনমরণের প্রশ্ন। আবার, নিয়ন্ত্রণ মানেই নিষেধাজ্ঞাও নয়। কেবল কিছু আইন আর বিধি মেনে চলা। আমরা আমাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে জানি।

নিয়ম মেনে চলা যে এ জাতির সংস্কৃতি নয় সেটাও জানা। এবং সেজন্যই সর্বাগ্রে প্রয়োজন যথার্থ প্রশাসন। এদেশে সেই বস্তুটির অভাব প্রকট। শাসকরাও সবাই তোমারই ইচ্ছা বলে নিশ্চিন্ত থাকেন, দুর্ঘটনা ঘটলে বড় বড় বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে অকুস্থলে পৌঁছে শোক প্রকাশ করে এসে দায়িত্ব শেষ করেন।

নিশ্চয়ই আগুন আর বিস্ফোরণের মত ঘটনা রোধে চাই সচেতনতা আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সব স্তরের কর্তাদের একটু মানবিকতা প্রয়োজন, একটু কাণ্ডারির ভূমিকা নেওয়ার তাগিদটুকু বড় দরকার। কারণ বিপদ সবার।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।