প্রশ্ন ফাঁস হওয়া কক্ষটি ব্যবহার করেন না বিমানের এমডি!

প্রকাশিতঃ 7:25 pm | November 04, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তোলপাড় চলছে। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে নিয়োগ কমিটিতে থাকা একজন কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে বিমানের এমডির কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার খবরের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন বিমানের এমডি মো. যাহিদ হোসেন।

অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি পরিচালক (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করলেও সেই কক্ষটি প্রায় ৫ মাস যাবত ব্যবহার করেন না। ফলে এমডির কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোন সুযোগই নেই। পাশাপাশি এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে রহস্য তৈরিকারীদের অপচেষ্টা দিনশেষে হালে পানি পাবে না বলেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এমডি।

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেন কালের আলোকে বলেন, ‘আমি এমডি পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পরিচালক (প্রশাসন) কক্ষটি ফাঁকা। কারণ এই পদটিও ফাঁকা। এই কক্ষে আমার কোন যাতায়াত নেই। এটি সিসিটিভি চেক করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। একই সঙ্গে ফৌজদারী তদন্ত হচ্ছে। পুলিশি তদন্তে আমার আস্থা রয়েছে। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে কারা জড়িত।’

ডিবি সূত্র জানায়, গত ১৯ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) অফিস কক্ষে পরীক্ষা কমিটির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যাচাই-বাচাই করতে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে কো-অপ্ট করা সদস্যরাও ছিলেন। সেখানে প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করে তা প্রিন্ট দেওয়া হয়। সেখান থেকেই ওই কর্মকর্তা নিজের মোবাইল ফোনে এক কপি ছবি তুলে নিয়ে যান। এরপর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেন।

ওই ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা কমিটিতে থাকা যে কর্মকর্তা প্রশ্ন ফাঁস করেছেন, তারই দায়িত্ব ছিল এসব প্রশ্নের নিরাপত্তা দেওয়া; কিন্তু তিনি তা না করে তা নিজের গাড়িচালক-অফিস সহকারীর মাধ্যমে ফাঁস করে টাকা হাতিয়ে নেন। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রশ্নফাঁসে সম্পৃক্ত কর্মকর্তার নাম বলেছেন। তবে বিষয়টি আরও যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। পুরো ঘটনা এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।

গত ২১ অক্টোবর বিকেল ৩টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ১০০ চালকসহ বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগে এক ঘণ্টার এমসিকিউ পরীক্ষা ছিল। ওই পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ পাওয়ায় ডিবির লালবাগ বিভাগের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারের অভিযান শুরু করে। পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর সে পরীক্ষা বাতিল করা হয়।

ওই ঘটনায় প্রথমে জড়িত সন্দেহে সংস্থাটির এমটি অপারেটর (গাড়ি চালক) জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ মাহফুজ আলম ভূঁইয়া, এনামুল হক, অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেন ও হারুনুর রশিদকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ডিজিএম সিকিউরিটির গাড়িচালক মো. মাসুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও অফিসের অফিস সহকারী মো. জাহিদ হাসান, পরিচালক প্রশাসন অফিসের অফিস সহকারী সমাজু ওরফে সোবাহান, সংস্থাটির ওয়ার্কশপ হেলপার মো. জাবেদ হোসেন এবং ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের অফিস সহকারী মো. জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তারা গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ওই মামলার তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির কর্মকর্তারা। সেখানে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে জড়িত কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ছিল সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা; কিন্তু তারা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা নিয়োগ কমিটির সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি বলেছেন। তাদের দায় রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় যাদের দায় রয়েছে, প্রশ্ন ফাঁস করেছেন, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার সদস্যদের কাউকে ফোনে, কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’

বিমানের চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে। আরও অনেক ব্ল্যাংক চেক উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, গোয়েন্দা তথ্য, ডিজিটাল অ্যানালাইসিস, পুলিশ ও বিজ্ঞ আদালতে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রদত্ত জবানবন্দি এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায়, এ চক্রটি বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ঘটনায় জড়িত। এ নিয়োগের প্রশ্নপত্র মহাব্যবস্থাপকের (প্রশাসন) সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফটোকপি হচ্ছিল প্রশাসন বিভাগের পরিচালকের অফিস কক্ষে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ১০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে পুরো ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয় ও এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সম্প্রতি বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়ে জঙ্গি ধরা’র মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি ইতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করতে গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বিমানে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ছিল ড্রাইভারদের প্রশ্ন। তাদের কী পরীক্ষা হয় বলেন? আমি নিজেও পরীক্ষা দিয়েছি। ড্রাইভারদের পরীক্ষা হয় সরাসরি ড্রাইভ করার সময়। এরপরও প্রশ্ন আউট হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তদন্ত করা হবে। এটাকে এমন পর্যায়ে প্রচার করা যাবে না যে, অনেকগুলো ক্যামেরা এনে ’জঙ্গি ধরা’র মতো পরিস্থিতি তৈরি করা। এসব অবস্থা তৈরি করার কোনো মানেই হয় না।’

সূত্র জানায়, বিমানের এমডি পদে মো. যাহিদ হোসেন দায়িত্বভার গ্রহণের পর কৌশলগত নানা ইতিবাচক পদক্ষেপে বিমান লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। দু’ঘন্টার স্থলে এখন মাত্র ৪৫ মিনিটে মিলছে লাগেজ। বেড়েছে যাত্রী সংখ্যা ও টিকিট বিক্রি। এতে করে রাজস্ব আয়ও বেড়েছে। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির লাগাম টেনে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যাদের বিরুদ্ধেই তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্য কোন এয়ার ক্রাফট ছাড়াই বিমান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হজ ফ্লাইটের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ইত্যাকার কর্মকৌশলে চমক দেখিয়েছে। এসব ঘটনায় স্বভাবতই কোন কোন মহল অসন্তুষ্ট।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী নিজেও বলেছেন, ‘বিমান সেবায় আমাদের যে ডিমান্ড সে তুলনায় যাত্রী সংখ্যা বেশি, জনবল কম। পরিবহনও কম। এই সমস্যা সমাধানে আগামী অক্টোবরে নতুন বিমান বন্দর উদ্বোধন হবে। তখন আর কোনো অসুবিধা হবে না।’

কালের আলো/এএমএমকে

Print Friendly, PDF & Email