‘এই দেশে সাংবাদিক খ্যাদাইতে কোন নীতিমালা থাকা লাগে না’
প্রকাশিতঃ 3:25 am | May 08, 2019

শারমিন শামস্ ::
দেশ টিভির ৩২ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হইসে। একেবারে হুট করে। অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই নাকি তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছিলেন না। দেশ টিভির জন্য এই ঘটনা নতুন কিছুই না। ২০০৮ সালে আমি দেশ টিভিতে যোগ দিই। টানা এক বছর আমাদের নাকের সামনে মূলা ঝুলায়ে রাখতেন মালিকেরা।
প্রতিবার মিটিংয়ে আইসা বলতেন, সামনের মাসে অনএয়ার। আমরা প্রস্তুত হইতাম। কিন্তু সংশয় কাটতো না। কারণ অফিসের কন্সট্রাকশন, ডেকোরেশন, যন্ত্রপাতি আনা বসানো কিছুই হয় নাই। এর মধ্যে একটা টিভি স্টেশন কীভাবে অনএয়ারে যাবে? তারা কইতেন, এই এক মাসেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তাদের তাল দিতেন আমাদের বিশিষ্ট বড় বড় সাংবাদিক বসেরা।
তো যথারীতি অনএয়ারে আসতো না। এইভাবে বড় বড় ঘটনা একের পর এক ঘটে যেতে লাগলো। নির্বাচন পর্যন্ত হয়ে গেল। টিভি অনএয়ার হয় না। সাংবাদিক সাইফুল আলম চৌধুরী মন খারাপ করে একদিন মিটিংয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের ক্ষমা করব না, এত বড় ইভেন্ট মিস করলাম’। আমরাও অনেক ক্ষোভ জানাইলাম। তাও তাদের কোন বিকার নাই। টিভি আর আসেই না।
অবশেষে ২০০৯ এর মার্চে টিভি অনএয়ার হইল।
আমরা কাজ শুরু করলাম। আমি এ কথা অস্বীকার করি না যে, দেশ টিভির ওই তিনটি বছর আমার সাংবাদিকতার জীবনে খুব দামী তিন বছর। কারণ আমি যাদের কাছে সেখানে কাজ শিখেছি ও যাদের সাথে কাজ করেছি, তারা সবাই ছিলেন অসাধারণ। আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে ভাল রিপোর্টিংগুলো দেশটিভিতে থাকতে করা।
তো কাজ করি। আমি প্রধানমন্ত্রীর বিট করি। এসাইনমেন্টে যামু। দেখি গাড়ি নাই। গাড়ি গেছে বড় সাহেবের মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে। ট্যুরে যাই। রাস্তায় ভাংগা গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ডাকাতভরা এলাকায় বসে থাকি নিরাপত্তাহীন। এরপর শুরু হল বেতন না হওয়া। জানুয়ারির বেতন পাই মার্চে।
ঈদের বোনাস পাই ঈদের আগের দিন, তাও শেষ মুহুর্তে। সবচেয়ে যেটা অদ্ভুত এই অফিসে সাংবাদিকদের শান্তিতে কাজ করার কোন সুযোগ নাই। তারা কোথায় বসে খাবে, সেই জায়গাটা পর্যন্ত নাই। আমরা লাঞ্চ নিয়া পিন্টু ভাইয়ের (তখন সিএনই) রুমের সামনে ঘুরাঘুরি করি। পিন্টু ভাই কাগজপত্র সরায়ে ডাক দেন, ওরে আয় খেয়ে যা।
আমরা থালা বাটি সাজায়ে তার টেবিল বসে খাই। তিনি কাজ করেন।
পানি খাব, একটা গ্লাস নাই। একবার অফিস এসিসটেন্ট একটি ভাল কাপে কাকে যেন চা এনে দিল নিউজরুমে। ম্যানেজমেন্টে সেটা নিয়া কথা উঠলো। বলা হল, মালিক শ্রমিক এক কাপে চা খায় না।
তো আমার মেজাজ খারাপ হয়। আর সবার মতই। যেহেতু আমি গাধা এবং মনের কথা মনে রাখতে পারিনা, আমি একটা স্ট্যাটাস লিখলাম, ম্যানেজমেন্টের দালালি যারা করে তাদের নিয়া। কোথাও লেখা নাই দেশ টিভির নাম। কিন্তু কমেন্টে লোকে কিছু কথা কইলেন। তাতে বুঝা গেল সেটা দেশ টিভি।
তো এতে নূর ভাই ম্যালা দুঃখ পাইলেন।
আমারে ডাকলেন সাদিকুর রহমান পরাগ। তিনি দেশ টিভির বড় কর্তা। কইলেন, চাকরি ছাইড়া দেন। সাবের ভাই চাইছেন।
রাতে নূর ভাই আমারে ফোন দিলেন। দিয়া আধা ঘণ্টা কথা কইলেন। বললেন, তিনি নিজেও নাকি ম্যালা দুঃখে আছেন।
আমি আজো জানিনা, তার দুঃখটা কী!
তো, চাকরি যেদিন ছাইড়া দিলাম, সেদিন নিজেরে খুব অপমানিত লাগলো। আপনমনে হাঁটা ধরলাম। মগবাজার থিকা মোহম্মদপুর আইলাম।
এরপর এত বছরে দেশ টিভির কলিগদের দেখছি বেতন নাই, বোনাস নাই, ইনক্রিমেন্ট নাই দেখে হাহুতাশ করতেসেন। তারা আমার কাছে চাকরির খোঁজও করতেন।
অবশেষে দেখলাম ৩২ জনের চাকরি গেল।
এই দেশে সাংবাদিককে চাকরি থেকে খ্যাদাইতে কোন নীতিমালা থাকা লাগে না। সাংবাদিক এই দেশে সবচেয়ে সস্তা। সবচেয়ে সস্তা।
লেখক: সাংবাদিক
লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।