খুনের বিচার হয় না ঢাবিতে
প্রকাশিতঃ 6:30 am | May 16, 2025

ঢাবি প্রতিবেদক, কালের আলো:
স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৭৬ জন মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় বেশিরভাগই শেষ পরিণতি দেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধ, দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দল-উপদলের দ্বন্দ্ব ও নারীঘটিত কারণে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করে। আইন অনুযায়ী মামলাও করা হয়। কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো চূড়ান্ত বিচারের মুখ দেখে না।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একদল দুর্বৃত্ত ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় আলোড়ন তৈরি হয়েছে ক্যাম্পাসে। একাধিক বিক্ষোভ কর্মসূচি ও ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ছাত্রদল এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই সাম্য হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। অতীতে বিচার না হওয়ায় শঙ্কাও প্রকাশ করছেন অনেকে।
জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন (৩২) নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে হলের একদল শিক্ষার্থী।
এ ঘটনায় ৮ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরমধ্যে ৬ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছে। তবে এখনো এ বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই।
এর আগে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্যার এ এফ রহমান হলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পড়ে খুন হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকর। ২০১৭ সালে এ মামলার রায়ে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মী বেকসুর খালাস পান। অথচ রায়ের ব্যাপারে নিহতের পরিবার কিংবা বাদীকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। সেসময় ১০ শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বহিষ্কার করে। তবে পরে হাইকোর্টের রিটের পর ২০১২ সালে তাদের বহিষ্কারাদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ ঘটনায় পুনরায় উচ্চ আদালতে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঢাবি ক্যাম্পাসে এ পর্যন্ত ঠিক কতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সে সম্পর্কে কোনো নথি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৪ থেকে সর্বশেষ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৭৬টির মতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত চারজন বহিরাগত। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধী চূড়ান্ত শাস্তি পায়নি। অনেক মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক। কিছু মামলার সাজার আদেশ হওয়া আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু মামলা এখনো তদন্তাধীন বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মনে করেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এবং বিচার না হওয়ার ঘটনায় মূল দুর্বলতা রাজনৈতিক। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটা উচিত নয় এবং স্বাভাবিকও নয়। বেশ কয়েকটি ঘটনা বিবেচনা করলে এসব ঘটনা হয়তো সমাধানও করা যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে তো কোনো কিছুই সেভাবে বিবেচনা করা হয় না। সেকারণে বিচারও হয় না।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এড়াতে পারে না। সর্বশেষ ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার ঘটনায়ও তাদের দায় আছে বলে আমরা মনে করি।’
তবে ঢাবি শাখা শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘এই অভিযোগটা পুরোপুরি সঠিক নয়, ফ্যাসিবাদের সময়ে বিচারহীনতার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তবে নতুন বাংলাদেশে এটির কোনো সুযোগ নেই। তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় আমরা দেখছি আটজন গ্রেপ্তার হয়েছে। এরপরও যদি বিচারহীনতার সংস্কৃতি ফের ফিরে আসে, তাহলে ছাত্রশিবির তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে।’
কালের আলো/এমএএইচএন