লকডাউন শিথিলে ঝুঁকি দেখছেন প্রতিমন্ত্রী, ৩৩৩’তে ভুয়া কলে অ্যাকশনের হুঁশিয়ারী সচিবের

প্রকাশিতঃ 9:50 am | May 03, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

করোনা মহামারি উজাড় করছে পুরো বিশ্ব। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশ ভারত। করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ প্রবলভাবে আঘাত হেনেছে দেশটিতে। ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। নিত্যদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

পড়শি দেশের ভয়াবহ অবস্থায় শঙ্কামুক্ত নয় বাংলাদেশও। কয়েক দফায় চলছে লকডাউন বা কঠোর বিধি নিষেধ। মিলেছে সুফলও। গত কয়েকদিনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও প্রাণহানি কমেনি। এমন কঠিন বাস্তবতায় লকডাউন শিথিল করতে চাইলে বড় রকমের ঝুঁকির শঙ্কার কথা জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

আবার, দীর্ঘ লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষজন। এসব দরিদ্র, দুস্থ, অসচ্ছল ও ভাসমান মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করছে সরকার। বিভিন্ন পেশায় কাজ হারানো প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ঈদ উপহার দিচ্ছেন। ইতোধ্যেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩৩ লাখ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে।

যাচাই বাছাই করে তালিকা প্রস্তুত থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিতরণ পদ্ধতিও উন্নত করা হয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রমেও বেশি প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন। এই মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে একজন মানুষও ক্ষুধার জন্য কষ্ট করবে না বলেও নিজের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন তিনি।

রোববার (০২ মে) রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ডিবিসি নিউজের জনপ্রিয় ‘রাজকাহন’ নামক টকশোতে পৃথক পৃথকভাবে এসব কথা বলেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন।

লকডাউন শিথিল করলে বড় রকমের ঝুঁকি
উপস্থাপক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন আগামী ৫ মে’র পরে লকডাউন নিয়ে পরিকল্পনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি বলেন, ‘এ বিষয়টি স্বাস্থ্য বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি বলতে পারবে। এই যে করোনা বৃদ্ধি, পাশের দেশ ভারতের যে অবস্থা এসব বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হচ্ছে। আমাদের এখানে করোনা সংক্রমণ হ্রাসের জন্য আমরা বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

কয়েক দফা লকডাউনের সুফলের কথা জানিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যাটি সেভাবে কমেনি। এটি সন্তোষজনক নয়। সেটিও আমাদের দেখতে হবে। আমরা চলাফেরার ওপর নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর ব্যাপকভাবে জোর দিয়েছি। এরপরও জীবন-জীবিকার স্বার্থে দোকানপাট কিছুটা খুলে দিতে হয়েছে। কারণ তাঁরা ঈদে ব্যবসা করে। ইতোমধ্যেই পহেলা বৈশাখ তারা মিস করেছে। এ কারণে জীবিকাও চালিয়ে নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শ, আমাদের পাশের দেশ ভারতে করোনায় ভয়ঙ্কর পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা খুবই পাশাপাশি দু’টি দেশ। সেখানে আমাদের চোখ রাখতে হচ্ছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এটিকে যদি আমরা শিথিল করতে চাই তাহলে বড় রকমের ঝুঁকি রয়েছে। সেটি মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।’

ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বিতভাবেই করা হচ্ছে জানিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। গতবার আমরা ব্যাপক কাজ করেছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ঝড়, বন্যায় একটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমার মেহেরপুর জেলাতে ২০০ মেট্টিক টন খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া আছে। এর মধ্যে ১৮ মেট্টিক টন দেওয়া হয়েছে। বাকীটুকু এখনও রয়ে গেছে।’

দেড় কোটি লোক দরিদ্র হয়ে গেছে, এ প্রশ্নে প্রবল আপত্তি তুলে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এই প্রজেকশন আমরা দেখছি না। ফ্যাব্রিকেটেড অনেক ব্যাপার রয়েছে। আমি আশাবাদী সরকার যৌক্তিকভাবে একটি ব্যাখ্যা দিবে। এই তথ্য যে ঠিক না সেই ব্যাখ্যা যৌক্তিকভাবে আসবে বলেই আমি মনে করি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগের বিষয়ে কোন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেয়নি। কারণ ঢাকাকে স্পেশালি দেখতে হবে। কোন মানুষ যেন ঢাকায় না আসে আবার কোন মানুষ যেন ঢাকা থেকে না যায়। বিভিন্ন জায়গায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা ঢাকা থেকে গিয়েই আক্রান্ত হচ্ছেন। আমার মেহেরপুর জেলায় ২২ জন আছেন, তারা ঢাকা থেকেই গিয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মানবিক সহায়তার প্রস্তুতি অনেক বেশি
‘করোনার গতবারের প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবারের মানবিক সহায়তার প্রস্তুতি অনেক বেশি’ টকশোতে নিজের প্রারম্ভিক আলোচনার শুরুতেই এমন সুসংবাদই দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন। তিনি বলেন, ‘ এবার আমরা ইউনিয়ন ভিত্তিক বরাদ্দ দিয়ে রেখেছি। গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত শুধুমাত্র আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে ৩৩ লাখ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৯৪ লক্ষ। এক সপ্তাহ আগে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৩৩৩ নম্বর। এই নম্বরে ফোন করে রোববার (০২ মে) পর্যন্ত ৯ হাজার মানুষ খাদ্য সহায়তা পেয়েছে। এই হিসেবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।’

৩৩৩ নম্বরের সুবিধার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির যেসব মানুষ লাইন ধরে খাদ্য নিতে পারেন না তারা এই নম্বরে ফোন করলে তাদের খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এখানে অনেক কল আসছে। এই কলগুলোকে দুইভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যিনি ফোন করছেন তাকে এটুআই প্রকল্প থেকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়। জানতে চাওয়া হয় আপনার ইনকাম কত? আপনার বাড়ি কোথায়? তারা (এটুআই) পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে সেই সংখ্যাটি এসএমএস’র মাধ্যমে জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে প্রেরণ করছেন। ম্যাক্সিমাম ৪ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যে তাদের খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমাদের লোকজন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরাও থাকছেন।’

তবে অসংখ্য ভুয়া কলের কারণে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি জানিয়ে সচিব মো. মোহসীন বলেন, ‘অনেক উৎসুক মানুষ ফোন করছেন প্রথমে, পরে তারা ক্ষমা চাচ্ছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই পরিবারের ৩ জন ফোন করছেন। পরে তারাও ভুল স্বীকার করছেন। আমরা প্রচার করছি এই ধরণের ফলস কল করলে অ্যাকশন নেওয়া হবে। মাত্র এক সপ্তাহ যাবত ৩৩৩ চালু হয়েছে। আগামী ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে এর ব্যাপক পরিচিতি হবে বলেই আমি মনে করি।

কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে এ পর্যন্ত তাঁর মন্ত্রণালয় ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জানিয়ে ত্রাণ সচিব আরও বলেন, ‘আজকেও (রোববার) আমরা ১১ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা দিয়ে এসেছি। এই টাকা বিতরণের জন্য ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে বিতরণ করার জন্য। তারা মানুষের কাছে যাচ্ছে। একটি তালিকা আছে এবং তালিকা রিভিজিট করতে হচ্ছে। মানুষকে আসতে হচ্ছে এবং দিতে হচ্ছে।’

ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম উন্নত করা প্রসঙ্গে মো.মোহসীন বলেন, ‘এই বছর চেয়ারের মধ্যে বসিয়ে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। এই সিস্টেম অনেক উন্নত হয়েছে। মানবিক সহায়তা বিতরণ কার্যক্রমও উন্নত হচ্ছে। এই বছর কোথাও ত্রাণ নিতে এসে মাটিতে বসতে হচ্ছে না। চেয়ারের বসানোর মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে।’

বিতরণ কার্যক্রম একটি জটিল কাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে এটিও ভাবতে হবে। আমাদের বরাদ্দ প্রচুর আছে। আমি বললাম ৩৩ লাখ মানুষকে কেবলমাত্র আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে স্পেশাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। যেটা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় (জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) বললেন, সকালে আমরা টেলিভিশনে দেখলাম। এছাড়া মৎস্য ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও দেওয়া হচ্ছে।

এ পর্যায়ে উপস্থাপক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবকে প্রশ্ন করেন, ‘যে তালিকা ধরে দেওয়া হচ্ছে, সেটি গত বছরের তালিকা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিচ্ছেন সাড়ে ৩৬ লাখ, সেটিও গত বছরের তালিকা অনুযায়ী। এ বছরের প্রতিবেদন, গবেষণা বলছে, এই বছর দেড় কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। তারা কবে তালিকাভুক্ত হবেন, কীভাবে হবেন?’

জবাবে এই সচিব বলেন, ‘এই বছর গত বছরের চেয়ে সংখ্যা কম হবে। এই বছর প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা। গার্মেন্টসের ৪৫ লক্ষ লোকবল। সব খোলা আছে। দোকান ইতোমধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা গত বছর প্রায় ৭ কোটি টোটাল জনগণকে দিয়েছিলাম। আমাদের হিসাবে এই বছর সংখ্যা কম হবে। কারণ এবারের লকডাউনে অনেক কিছু খোলা, তাই সংখ্যাটি কমে যাবে। যদিও আমরা প্রচুর বরাদ্দ দিয়েছি।’

সামনে দুর্যোগ এলে প্রস্তুতি কেমন এই মন্ত্রণালয়ের, উপস্থাপিকার এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব মো.মোহসীন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজকেও বলেছেন, একজন মানুষও যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পান। আমরা আপদকালীন পরিকল্পনাও করে রেখেছি। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় (জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) বললেন, আমরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে যে বরাদ্দ দিয়ে রেখেছি, তারা এখন বিতরণ করছে সেটি। আমাদের পুরোপুরি সব পরিকল্পনা রয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার বাজেট বেশি, বিতরণের সিস্টেমও ভালো, তালিকা আরও বেশি স্পষ্ট করে করা হয়েছে । মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে কোন মানুষ ক্ষুধার কষ্ট করবে না আমরা এমনভাবেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’

কালের আলো/এসআর/জিকে

Print Friendly, PDF & Email