টিকা ব্যবস্থাপনার মত সুষ্ঠু হোক স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিতঃ 10:33 am | February 22, 2021

সফিউল আযম :

বাংলাদেশে এখন টিকা উৎসব চলছে। সরকার সঠিক পদক্ষেপে একটি সফল ও ব্যতিক্রমী টিকা উৎসবে মুখরিত পুরো দেশ। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশে খুব দ্রুত টিকা আসে। প্রথম দিকে জনমনে একটু সংশয় থাকলেও বর্তমানে টিকাকেন্দ্রে ভীড় প্রমাণ করে এখন আর সংশয় নেই। এখন বইছে স্বস্তির বাতাস।

টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং সে অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা টিকা কর্মসূচিকে উৎসবে পরিণত করেছে একথা বলা যায়। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি রয়েছে। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি, টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ, জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় কমিটি হলো কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি। দেশে করোনার টিকাদান কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১৬ সদস্য বিশিষ্ট জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত।

সাহেদ কিংবা সাবরিনা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের মধ্যে কীভাবে এদর আগমন ঘটেছে কিংবা প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলো এখন সবারই জানা। কিছু ব্যক্তির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে গভীর সংকটে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে নানা অভিযোগ।

স্বাস্থ্যের বাইরে অন্যান্য বিভাগের প্রতিনিধিত্ব থাকায় টিকার কমিটির পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। দেশে প্রথম করোনা টিকা উদ্বোধন হয় ২৭ জানুয়ারি। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৮ জন মানুষ করোনার টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৪৯ জন। এটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সাফল্য। দেশব্যাপী এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে কথায় হয় বেশ কয়েকজন টিকা গ্রহণকারীর সাথে।

সাংবাদিক সাহাবুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, করোনা টিকা কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, এত সুন্দর অভিজ্ঞতা হবে বলে কখনও কল্পনাও করিনি।

জাপানের হিতসুবাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক বিল্লাল বাপ্পী, কয়েকজন বন্ধু মিলে টিকা গ্রহণ করেন সীতাকুন্ডে। তিনি জানান, বাংলাদেশ টিকা গ্রহণ কর্মসূচি এত সূচারুরূপে আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেন, টিকা একটি উৎসবের মত আয়োজন, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একই কেন্দ্রে টিকা গ্রহণ করি, টিকা ব্যবস্থাপনা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা নিশাত আরা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হাজি মহসীনকে টিকা কেন্দ্র বেছে নেন। টিকা কিংবা ইনজেকশন ভীতি ছোটবেলা থেকেই এই গৃহিনীর। গত মঙ্গলবার যথারীতি হাজির হন টিকা কেন্দ্রে। তিনি জানান, টিকার ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে টিকাভীতি দূরীভূত হয় নিমিষেই। সুন্দর ও একটি সুষ্ঠু পরিবেশে টিকা গ্রহণ ও টিকা পরবর্তী একটি সহায়ক পরিবেশ মন ভাল করে দেয় বলেও জানান তিনি।

করোনার টিকা ব্যবস্থাপনার মত স্বাস্থ্য খাতে অনেক অর্জন রয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মাতৃমুত্যু হার হ্রাস, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, পোলিও নির্মূল, পরিবার পরিকল্পনা খাতের উন্নয়ন। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতেও সফল বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার কর্মসূচি কমিউনিটি ক্লিনিক। এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে।

টেলিমেডিসিন সেবায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নাগরিকগণ এখন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকের কাছ থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতে পারছেন। এই সেবা চালুর ফলে গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত ধনী-গরীব সকলের জন্যই বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসকদের নিকট থেকে চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যস্ত মানুষেরাও রোগের শুরুতেই পরামর্শ নিতে পারেন চিকিৎসকের। এর ফলে রোগ জটিল হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়।

এত কিছুর পরও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কিছু অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠে করোনাকালে। করোনা আমাদের দেখিয়ে দেয়, আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা নাজুক। ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা সোহানা ইয়াসমিন। গভীর রাতে পেটব্যথা দিয়ে কাতরাতে থাকেন। ছুটেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। ভর্তি হতে পারন না। প্রচণ্ড ব্যথা বেদনা দিয়ে সারারাত কাটাতে হয় অ্যাম্বুলেন্সের নিথর সিটে। সোহানা ইয়াসমিনের মত হাজারো রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েন এই করোনায়। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনা ঢাকাসহ সারাদেশ আইসিইউ সংকট কতটা প্রবল, করোনাকালে টের পেয়েছে দেশের জনগণ।

সাহেদ কিংবা সাবরিনা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের মধ্যে কীভাবে এদর আগমন ঘটেছে কিংবা প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলো এখন সবারই জানা। কিছু ব্যক্তির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে গভীর সংকটে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে নানা অভিযোগ। গত বছর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মচারীদের মারধরে কিভাবে পুলিশের একজন এএসপি নিহত হন। যেখানে নামকরা সরকারি একটি হাসপাতালের রেজিস্টার ও পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এবং গ্রেফতার হন।

খোদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের ২০ অক্টোবর একজন নবজাতককে মৃত ঘোষণা করে পরিবারকে হস্তান্তর করেন। পরিবারের লোকজন ধর্ম মতে দাফনের সময় শিশুটি নড়ে উঠে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের গাড়ির ড্রাইভারের বিত্ত বৈভবের নানা সংবাদে গত বছর ছিল সরগরম। কীভাবে একজন গাড়িচালক বণে যান শত কোটি টাকার মালিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আত্মীয়দের নিবাস কিংবা টেন্ডারবাজিতে ছিলেন দূরদর্শী।

কোভিড-১৯ এর কারনে অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরাও চিকিৎসা পাননি বলে খবরে প্রকাশ। কেন্দ্রীয়ভাবে সঠিকভাবে তদারকির প্রকট সংকট চোখে পড়ে। তারপর দৃষ্টি দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ স্বাস্থ্য খাতকে একটি উন্নত সেবাখাত হিসেবে তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে করোনাকালে আমরা দেখেছি জীবনের মায়া ত্যাগ করে কীভাবে ডাক্তার ও নার্সরা সেবা দিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক চিকিৎসক। সম্মুখ সারির এসব যোদ্ধারা দেখিয়েছেন মানবতা কীভাবে বেঁচে আছে।

স্বাস্থ্য খাতে উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিকীকরণের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। অভিযোগ আছে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও টেস্ট দিয়ে অতিরিক্ত খরচের দিকে রোগীকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সাথে নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারিভাবে পরীক্ষা নিরিক্ষার সুযোগ আরো সম্প্রসারণ করা দরকার। যাতে রোগীরা সহজেই নির্ভুল সেবা পায়।

অনেকেই বলেন কিছু কিছু ডাক্তারদের কাছে গেলে রোগ ভাল হয়ে যায়, ঔষধও খেতে হয় না। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও রয়েছে অনেক। অনেকের আচরণে রোগীরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্পর্কিত সকলের জন্য নৈতিকতা ও সামাজিকীরণের প্রশিক্ষণও প্রয়োজন।

আমাদের রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বেশি থাকে। এটিকে কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতালে থাকার কথা জটিল ও মূমূর্ষ রোগীদের। কিন্তু আমাদের এখানে তার ব্যতিক্রম। তুলনামূলক কম ও অল্প চিকিৎসায় রোগ সেরে উঠবে এমন রোগীদের অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরো সম্প্রারণ করা দরকার। বর্তমান সরকার সারাদেশের হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিক করার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সে হিসেবে জনবল কিন্তু বাড়ছে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে জনশক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-২০৩২) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি ও তার অধিকতর সুষম ব্যবহারের একটি রূপরেখা। কৌশলপত্রটি ২০১১-২০১৬ মেয়াদি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচির (এইচটিএনএসডিপি) লক্ষ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য কর্মসূচির সার্বজনীন নীতিমালা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১-র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই কৌশল পত্রটি আরো বৃহৎ পরিসরে দ্রুত বাস্তবায়নের পথে আমাদের এগুতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকালে সেবা গ্রহীতার আর্থিক সুরক্ষায় এই কৌশলপত্রটি কার‌্যকর ভূমিকা রাখবে।

যেভাবে সারাদেশে একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে করোনা টিকা কর্মসূচি চলছে, স্বাস্থ্যখাতকে এভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। প্রতিটি পর্যায়ে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বৃহৎ পরিসরে এবং সঠিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ রয়েছে। করোনার টিকা ব্যবস্থাপনার মতই সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হোক পুরো স্বাস্থ্যসেবা খাত।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।