নেতৃত্ব প্রচারের ‘বিজ্ঞাপনী প্রদর্শনী’ থামবে কবে?
প্রকাশিতঃ 1:58 pm | March 15, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :
কাপড়ের ব্যানারের চলন আর নেই। হাতেলেখা পোস্টারও অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। অবশ্য দু’একটি মানববন্ধনে কখনো-সখনো চোখে পড়ে এ ধাঁচের পোস্টার। রাজনীতিতে দেয়ালের ভাষাও এখন হয়েছে বিলীন! পুরনো এসব প্রচারণার প্রথা ছাপিয়ে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে রাজনীতিতে।
তবে প্রচারণার আদি সংস্কৃতি হিসেবে বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে এখনো টিকে আছে মোড়ে মোড়ে তোরণ নির্মাণের প্রতিযোগিতা। আর কাপড়ের ব্যানার, হাতেলেখা পোস্টার, দেয়াল লিখনের জায়গা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে হালের বিলবোর্ড, ডিজিটাল ব্যানার বা প্যানাফ্ল্যাক্স।
এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের উঠতি নেতা-কর্মীরা রাজনীতির মাঠ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের চেয়ে ঢাউস আকারের এমন বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় অনেক এগিয়ে রয়েছেন।
এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে তুমুল সমালোচনা, টিপ্পনি কিংবা কঠোর বার্তা দেয়া হলেও মোটেও হুশ ফিরছে না নেতৃত্ব প্রচারের বা জনপ্রিয়তা প্রকাশের নীরব প্রদর্শনীতে ব্যস্ত দলটির নেতা-কর্মীদের।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের ওই সময়কার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিলবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারো ছবি ব্যবহার না করতে কঠোর নির্দেশনা জারি করেন।
কিন্তু ওই নির্দেশনা গা করতে দেখা যায়নি কোন নেতা-কর্মীকেই। প্রতিটি দিবসকে ঘিরে ময়মনসিংহ নগরীর এখানে-সেখানে চোখে পড়ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির চেয়েও নিজেদের বড় ছবি সম্বলিত প্যানাফ্ল্যাক্স কিংবা তোরণ।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নির্দেশনার আগে থেকেই দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সরকার-বেসরকারি কর্মসূচিতেই এমন বিজ্ঞাপনী রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন দলটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
দেশজুড়ে নেতার হিড়িক পড়ে যাওয়া আর তাদের প্রচারণার মুখ্য মাধ্যম হয়ে উঠা বিলবোর্ড, প্যানাফ্ল্যাক্সে যৎসামান্য লেখা সম্বলিত অভিনব জনপ্রিয়তা প্রকাশের মাত্রায় অসন্তুষ্ট মন্ত্রী কয়েক বছর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এখন বিলবোর্ডে নেতা আর নেতা।
আতি নেতা, পাতি নেতা, বড় নেতা, ছোট নেতা, সিকি নেতা। এরকম অসংখ্য নেতা। এটা নেতা উৎপাদনের বিরাট কারখানা।’ প্রথা বিরোধী এ রাজনীতিক ও মন্ত্রী ছন্দবদ্ধ উচ্চারণে সমকালীন বিলবোর্ড রাজনীতি, স্তুতি ও আচার-আচরণের বিরক্ত প্রকাশ করেন।
সূত্র মতে, নিজেদের জনসম্মুখে জাহির করার এ রাজনীতিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ থেকে শুরু করে মূল দল আওয়ামী লীগের অনেকেই প্যানাফ্লেক্স অথবা প্যানার বদৌলতে কর্মী থেকে একেবারে নেতা হবার অভাবনীয় ঘটনাও ঘটিয়েছেন। সংগঠনে কোন পদ পদবী না থাকলেও এমনকি লড়াই-সংগ্রাম ও জেল-জুলুমের সিঁড়ি পথ না মাড়িয়েই তারা নিজেদের নামের আগে-পরে ‘নেতা’ উপাধি জুড়ে দিচ্ছেন।
এ ধরণের প্রচারণার প্রবণতার কারণ সম্পর্কে দলটির মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, ‘আগে সাধারণত শীর্ষ পদধারী নেতারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে পোস্টার, ব্যানার কিংবা তোরণ নির্মাণ করতেন। কিন্তু ডিজিটাল ব্যানার বা প্যানাফ্ল্যাক্সের যুগে পাতি নেতারাও এ ধরণের প্রচারণা বেশি চালাচ্ছেন।’
নিজের জীবদ্দশায় একবার ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড আর তোরণের এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়ে কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত বিশেষ সহকারী, কবি ও রাজনীতিক মাহবুবুল হক শাকিল।
সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছিলেন-‘আমরা যারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসাবে দাবী করি তারা শোকের মাস আগষ্টে ব্যানার, ফেষ্টুন আর তোরণ দিয়ে যার যার এলাকা ঢেকে ফেলি। ব্যানারের এক কোনায় টিমটিম করে সন্ধ্যাতারার মতো জ্বলতে থাকে জাতির পিতার এক চিলতে ছবি।
ব্যানারের আকাশে সদম্ভ দখল নেয় আমাদের বিশালাকার ছবি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আঠারোজন সেই রাতে শহীদ হয়েছিলেন। তাদের ছবি তো দূরের কথা নামটিও থাকেনা। এসব অসুস্থ কারবার বাঙালির আর ভালো লাগেনা। আসুন, এসব বাদ দেই।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! হাইকমান্ড যত কথাই বলুক না কেন, আতি নেতা-পাতি নেতায় ভরপুর রাজনীতিতে নিজেদের নেতৃত্ব প্রচারের বিজ্ঞাপনী প্রদর্শনী থামেনি। আদৌ থামবে কীনা এমন প্রশ্নই সবার।
কালের আলো/আরএস/এমএম