ভারতের বাঙালি মুসলমানদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানোর অভিযোগ এইচআরডব্লিউ’র
প্রকাশিতঃ 3:31 pm | July 24, 2025

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, কালের আলো:
ভারতের জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শত শত বাঙালি মুসলমানকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। দেশটির বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ আখ্যা দিয়ে বেআইনিভাবে জোরপূর্বক তাদের সীমান্ত পার করানো হয়েছে বলে দাবি সংগঠনটির। বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) সংগঠনটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই অভিযোগ ও উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভারতের আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থানে এসব অভিযান চালানো হয়েছে। যারা সীমান্তে পৌঁছেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ভারতীয় নাগরিক এবং তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এইচআরডব্লিউ ১৮ জন প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা (বিএসএফ) অনেককে মারধর করে, ফোন ও কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে এবং অস্ত্রের মুখে জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আসামের সাবেক শিক্ষক খায়রুল ইসলাম (৫১) বলেন, ২৬ মে বিএসএফ আমাকে ও আরও ১৪ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে সীমান্তের ওপারে পাঠায়। আমি আপত্তি করায় তারা আমাকে মারধর করে এবং চারবার গুলি ছোড়ে। তিনি দুই সপ্তাহ পর ভারতে ফিরে আসেন।
২০১৯ সালে আসামের এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) থেকে ১৯ লাখের বেশি মানুষকে বাদ দেওয়া হয়। বাদ পড়াদের অধিকাংশই মুসলিম ও বাংলা ভাষাভাষী। তাদের অনেকে এখনও আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, আবার অনেকেই বিচারাধীন অবস্থাতেই সীমান্তে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
আসামের বরপেটা জেলার এক শ্রমিক, যার আপিল এখনও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। তাকে ২৪ মে রাতে আটক করে দুই দিন পর গভীর রাতে সীমান্তে নিয়ে ফেলে আসে বিএসএফ। তার ভাষায়, আমি মনে করেছিলাম, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। পরিবারের কেউ জানতও না আমি কোথায়।
৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন হাঁটতে পারেন না এবং চোখেও ভালো দেখেন না। তাকেও বিএসএফ ২৭ মে ভোরে সীমান্তে ফেলে দেয়। তার ছেলে বলেন, আমার মা ছয় বছর কোকরাঝাড় ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন, এখন আবার তাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে, ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ওড়িশা ও দিল্লিতেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া অভিবাসী শ্রমজীবী মানুষদের লক্ষ্য করে চলছে অভিযান। গুজরাটে এক মাসের মধ্যেই ১০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ও দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অমিত শাহকে লেখা এক চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গের এক সাংসদ জানান, গুজরাটে সম্পূর্ণ বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষকে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে ‘বাংলাদেশি’ বলা হচ্ছে।
ভারতের সীমান্তরক্ষীদের এই আচরণ সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি নয়াদিল্লি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮ মে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, এভাবে ‘পুশ-ইন’ বা জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো গ্রহণযোগ্য নয়। তারা বলেছে, কেবল যাচাইকৃত বাংলাদেশি নাগরিকদেরই গ্রহণ করা হবে এবং তা অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জানিয়েছে, ৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ভারত থেকে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী।
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, মে মাসে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। আরও ৪০ জনকে মিয়ানমার উপকূলে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় জানিয়েছে। তাদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতার কেটে উপকূলে পৌঁছাতে বাধ্য করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ একে ‘মানবিক মর্যাদার প্রতি অবমাননা’ বলে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতিরও লঙ্ঘন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মে মাসে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে অস্বীকৃতি জানায়। আদালতের মন্তব্য, যদি তারা ভারতীয় আইনে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হন, তবে তাদের ফেরত পাঠানো বৈধ। ১৬ মে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে পাঠানোর বিষয়ে করা অভিযোগ সম্পর্কে আদালত মন্তব্য করে, এটি একটি সুন্দরভাবে সাজানো গল্প।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, বিজেপি সরকার বাঙালি মুসলমানদের নিশানা বানিয়ে নাগরিকদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করছে। এর মাধ্যমে বৈষম্য ও বিভাজনকেই উস্কে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যা করছে, তা শুধু অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের চেষ্টাই নয়, বরং এর পেছনে ধর্মীয় বৈষম্যমূলক নীতি কাজ করছে। এর মাধ্যমে তারা ভারতের ঐতিহ্যবাহী শরণার্থী সুরক্ষা নীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, ভারতের এমন আচরণ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও বর্ণবাদী বৈষম্য দূরীকরণের দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেকোনও বহিষ্কৃত ব্যক্তিকে আইনি সহায়তা, অভিযোগ জানানোর সুযোগ এবং মানবিক সহায়তার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহার করা অতিরিক্ত বলের বিষয়েও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
কালের আলো/এএএন