মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: প্রাণহানি বেড়ে ৩৩, দগ্ধ পাঁচজনের অবস্থা সংকটাপন্ন

প্রকাশিতঃ 12:22 am | July 26, 2025

আব্দুল হামিদ/শফিকুল ইসলাম পলাশ, কালের আলো:

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শুক্রবার (২৫ জুলাই) জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাকিন (১৪) ও আইমান (১০) মারা গেছেন। দুর্ঘটনার পর থেকে তাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এর ফলে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ জনে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন অনেকেই। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৪০ জনের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তারা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। এই ট্র্যাজেডিতে ঝরে গেছে বহু শিক্ষার্থী, শিক্ষকের প্রাণ। যারা তখন ক্লাসরুম ও ক্যাম্পাসজুড়ে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতায় মগ্ন ছিলেন।

এদিকে, এ ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনায় দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (২৫ জুলাই) বাদ জুমা বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সারাদেশের মসজিদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি ইস্যু করে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

শুক্রবার (২৫ জুলাই) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি গণমাধ্যমকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন ১৫ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আরও ১৫ জন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (যার পরিচয় এখনও নিশ্চিত হয়নি) এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা গেছেন আরেকজন। তিনি আরও জানান, অনেকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

  • দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত
  • মৃত্যুর মিছিলে দগ্ধ মাহিন ও আইমান
  • অনবরত চোখের পানি ঝরছে রাইসা মনির বাবা-মায়ের
  • শিক্ষিকা মাসুকার কবরে বিমান বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান
  • পাইলট তৌকিরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন মির্জা ফখরুল

একই দিন বিকেলে বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন জানান, শুক্রবার পরপর দগ্ধ দুই শিক্ষার্থী বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা গেছে। এখানে এখনো ৪০ জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল (সংকটাপন্ন) অবস্থা পাঁচজনের। তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তাদের চেয়ে একটু কম গুরুতর অর্থাৎ সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রয়েছেন ১০ জন। আর ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে পোস্ট-অপারেটিভ রাখা হয়েছে আরও ১০ জনকে। বার্ন ইনস্টিটিউটের কেবিনে রয়েছেন ১৫ জন। তিনি জানান, সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারতের চিকিৎসক দল তাদের সঙ্গে এসব রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে বৈঠক করেছেন। তারা রোগীদের দেখেছেনও।

অনবরত চোখের পানি ঝরছে রাইসা মনির বাবা-মায়ের
চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছোট্ট রাইসা মনি (১১)। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়। মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এমন ঘটনায় শোকে স্তব্ধ পুরো গ্রামবাসী। ঘটনার পর থেকে অনবরত চোখের পানি ঝরছে রাইসা মনির বাবা-মায়ের। শুক্রবার (২৫ জুলাই) সকাল ৯টায় উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বাজড়া ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে বাজড়া কবরস্থানে তার দাফন হয়। সন্তানের এমন মৃত্যুতে শোকে কাতর শাহাবুল-মিম দম্পতি। রাইসা মনির জন্মের দুই বছর আগে তাদের কোলজুড়ে আসে সিনথিয়া (১৩) ও সবার ছোট ছেলে রাফসান শেখ (৪)।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রাইসা মনির বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানোর। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেই লক্ষ্যে ভর্তি করেছিলেন মাইলস্টোনে। রাইসা মনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তার বড় বোন সিনথিয়া। ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ওবায়দুর রহমান বলেন, রাইসা মনির অকালমৃত্যুতে পুরো এলাকার মানুষ শোকে বিহ্বল। তার মরদেহ বাড়ি পৌঁছানোর পর হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এমন কোনো মানুষ নেই তার জন্য কাঁদেনি। রাইসা মনির বাবা শাহাবুল শেখ বলেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের পরদিন ২২ জুলাই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি। পরে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে আমার মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করা হয়। রাতেই মেয়ের মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসি। বাড়ি পৌঁছাতে ভোর হয়ে যায়।

শিক্ষিকা মাসুকার কবরে বিমান বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত শিক্ষিকা মাসুকা বেগমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও গার্ড অব অনার প্রদান করেছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। শুক্রবার (২৫ জুলাই) দুপুর আড়াইটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সোহাগপুর গ্রামে মাসুকার সম্মানে গার্ড অব অনার প্রদান করে বিমান বাহিনীর ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি। পরে গার্ড অব অনার ও পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষ কবর জিয়ারত এবং মোনাজাত করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পরে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে সমবেদনা জানান তারা।

এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার মশিউর রহমান বলেন, ঢাকা খুবই স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন, যেখানে আমাদের নিরাপত্তা খুবই দরকার। যেহেতু ঢাকার আশপাশ এলাকায় জনবসতি অনেক বেড়ে গেছে, সেহেতু আমাদের সবকিছু কম্প্রোমাইজ করেই ফ্লাইয়িং করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যেকোনো সময় যেকোনোভাবেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকায় ফ্লাইয়িং হচ্ছে। এমন দুর্ঘটনা তো প্রতিনিয়ত ঘটে না।

পাইলট তৌকিরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন মির্জা ফখরুল
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে দেখা করেন তারা। শুক্রবার (২৫ জুলাই) বিকেল ৪টায় ঢাকা সেনানিবাসে বিমানবাহিনীর অফিসার্স মেসে এ সাক্ষাৎ করেন তারা। এসময়ে নিহত পাইলট তৌকিরের স্ত্রী আকশা আহম্মেদ নিঝুমসহ তার বাবা-মা-ভাইরা ও বিমান বাহিনীর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চ্যৌধুরী, বিমানবাহিনী প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শামসুল ইসলাম শামস, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শামসুজ্জামান খান। তৌকির ইসলামের মর্মান্তিক মৃত্যুতে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মির্জা ফখরুল। একই সঙ্গে শোকসন্তপ্ত এই পরিবারকে তাদের প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহমর্মিতার বার্তা পৌঁছে দেন তিনি।

কালের আলো/এমএএইচএন