গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে: আসক
প্রকাশিতঃ 6:07 pm | July 25, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্দেশ করে আক্রমণাত্মক মন্তব্যের কারণেই সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গুলির ঘটনা ঘটেছে। গুলিতে নিহত পাঁচজনের মধ্যে চার জনের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা চলাকালীন সময়ে নির্বিচারে নাগরিকদের আটক ও গ্রেফতার করার অভিযোগ রয়েছে। ১৮ জন শিশুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এমনকি, আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মত অভিযোগও উঠেছে। ভয়ে মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরপরাধ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলার যে সব এলাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নেই, সে সব এলাকাতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধর-পাকড়ের অভিযোগ রয়েছে।
গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং গুলিতে পাঁচ নাগরিক নিহত, বহুসংখ্যক আহত এবং পরবর্তী সময়ে গণ আটক, গ্রেফতার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুক্রবার (২৫ জুলাই) আসকের এই পর্যবেক্ষণ গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো হয়।
গোপালগঞ্জে গত ১৬ জুলাই রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আসক এসব ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে পর্যবেক্ষণে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, গোপালগঞ্জ জেলায় গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্ব নির্ধারিত রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলপ্রয়োগে এখন পর্যন্ত পাঁচ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন বহু সংখ্যক।
আসক এ ঘটনায় একটি প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান করেছে। ২১ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত দুদিনব্যাপী চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে নিহত, আহত, আটক বা গ্রেফতার হওয়া নাগরিকদের পরিবার, স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী এবং কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে জানানো হয়, সমাবেশে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী সমাবেশের দিনে আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সমাবেশস্থলে আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ জন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সমাবেশের সামনে রাখা চেয়ার ভাঙচুর করতে থাকে। এ সময় সমাবেশে যোগ দেওয়া আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ জন এনসিপি সমর্থক সমাবেশস্থল ছেড়ে ডিসি অফিসের দিকে চলে যায়। এরপর সমাবেশে যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা সংগঠিত হয়ে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে যায়। এ ঘটনার পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সমাবেশস্থলের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সমাবেশ সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ মুখে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকেরা অবস্থান নেওয়ায় পুলিশ এবং সেনা পাহারায় আনুমানিক দুপুর ১টার কিছু পরে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছায় এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। নেতারা তাদের বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে উঠার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকরা শহরের বিভিন্ন স্পটে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুরো শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে গুলিতে আহত ব্যক্তিদের সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে আহতদের মধ্যে চার জনকে মৃত ঘোষণা করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে সমাবেশ শুরুর পূর্ববর্তী হামলা এবং সমাবেশের পরবর্তী সময়ের সংঘর্ষের ঘটনায় হামলা কারীদের পক্ষ থেকে তীব্র ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনার কথা জানা গেছে এবং কারো কারো হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল বলে জানা যায়। হামলার সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও হামলাকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে—এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গুলির ঘটনা ঘটেছে।
আসক মনে করে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া ১৬ জুলাই রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আসক এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জানা যায়, এনসিপির নেতারা স্বল্প সংখ্যক সমর্থকদের উপস্থিতিতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এই মন্তব্যের পরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানিয়েছেন, বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধারণ জনতা’ রাস্তায় নেমে আসে, একপর্যায়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গোপালগঞ্জ জেলায় ১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা চলাকালীন সময়ে নির্বিচারে নাগরিকদের আটক ও গ্রেফতার করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মত অভিযোগও উঠেছে। ভয়ে মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরপরাধ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলার যে সব এলাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নেই, সে সব এলাকাতেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধর-পাকড়ের অভিযোগ রয়েছে।
আসকের তথ্য অনুসন্ধানকালে জানানো হয়, সমাবেশের আগের দিন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাবেশ স্থলের সন্নিকটের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশাসনের নির্দেশে দোকানপাট বন্ধ রাখেন দোকান মালিকরা।
সমাবেশ স্থলের কাছাকাছি এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে জানান, সমাবেশের দিন সকালে প্রশাসনের লোকজন জোরপূর্বক দোকান বন্ধ করে দেয় এবং কোথাও কোথাও দোকানের শাটার নামিয়ে দোকানের ভেতরে থাকা মানুষদের আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে। সমাবেশের দিনে সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকেরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাদের হাতে লাঠি-সোটা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল।
এই সহিংসতায় গুলিতে নিহত হন দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), ইমন তালুকদার (১৭) ও সোহেল মোল্লা (৩২)। পরে ১৮ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী নামের আরও এক ব্যক্তি। আসক এর অনুসন্ধান দল নিশ্চিত হয়, এই পাঁচজনের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া রমজান মুন্সীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। আসকের পক্ষ থেকে রমজান মুন্সীর সুরতহাল প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে এবং প্রতিবেদনে শরীরে গুলির চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
নিহত ইমন তালুকদারের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিনে আনুমানিক দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তারা হাসপাতালে ছুটে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকাল ৫টার দিকে মরদেহ দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও তারা বলেন, ইমনের শরীরে গুলির চিহ্ন এবং শরীরের মুখমণ্ডলসহ নানা স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরিবারের সদস্যরা আরো দাবি করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছেলেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় ফেলে মুখমণ্ডলে পা (বুট) দিয়ে আঘাত করছে, এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওতে যে ছেলেটিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আঘাত করছিল—সেই ছেলেটিই ইমন। ইমন কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, সে স্থানীয় ভেড়াবাজার এলাকার একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করতো।
একই অভিযোগ করেছেন নিহত রমজান কাজী, দীপ্ত সাহা এবং সোহেল মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকেও। তারা জানান, হাসপাতাল থেকে দ্রুত মরদেহ নিয়ে দাফন বা সৎকারের তাগিদ দেওয়া হয়। যার কারণে তারা মরদেহ নিয়ে এলাকায় চলে যান।
গণমাধ্যমে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন ও সৎকারের বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে গত ২০ জুলাই পুলিশের পক্ষ থেকে দীপ্ত সাহার পরিবার ছাড়া অন্য ৩টি পরিবারকে জানানো হয় পরিবারের সদস্যরা যেন ২১ জুলাই কবরস্থানে সকাল ১০টায় উপস্থিত থাকে এবং তাদের জানানো হয় মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জুলাই কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। রমজান কাজী ও ইমনের মরদেহ উত্তোলন ও সুরতহাল প্রক্রিয়ায় সরেজমিনে উপস্থিত ছিল আসকের প্রতিনিধি দল। পরিবারগুলো এই প্রক্রিয়াকে নতুন এক ধরনের হয়রানি বলে মনে করেন। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা যথাযথ বিচার দাবি করেছেন।
আসকের প্রতিনিধি দল গুলিতে আহত চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলেন। চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ একজন জানান, তার পেটে ও হাতে গুলি লেগেছে, হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি ইঞ্জিন চালিত রিকসায় তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে তিনি আহত হন। তিনি কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।
এ ছাড়া ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ১৮ জন শিশুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যাদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর আওতায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে আসকের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়। সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় ২১ জুলাই পর্যন্ত মোট ৮টি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ৬টি মামলার কপি আসকের তথ্য অনুসন্ধান দলের হাতে এসেছে। প্রাপ্ত মামলার কপিগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গোপালগঞ্জ সদর থানায় ৪টি, কোটালীপাড়া থানায় ১টি এবং কাশিয়ানি থানায় ১টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলোতে আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ জনকে। এর মধ্যে নামীয় আসামি ৩৫৮। এ সব আসামিদের মধ্যে ৩জন নারী এবং ৩২ জন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন।
এই ৬টি মামলার মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর থানার মামলা নম্বর ১৫, ১৬ এবং কাশিয়ানি থানার মামলা নম্বর ১৬; এই ৩টি মামলা সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর আওতায় দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া, সদর থানার মামলা নম্বর ১৭ ও ১৮ দণ্ডবিধি অনুযায়ী এবং কোটালীপাড়া থানার মামলা নম্বর ১৪; এই মামলাটি বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ১৫(১)(এ)/১৫(১)(বি) ধারায় দায়ের করা হয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সদর থানার মামলা নম্বর ১৭, তারিখ- ১৯/৭/২০২৫; গুলিতে নিহত রমজান কাজীর ঘটনায় বাদি হয়ে এই মামলাটি করেছে পুলিশ। একইভাবে, সদর থানার মামলা নম্বর ১৮, তারিখ ১৯/৭/২০২৫; গুলিতে নিহত দীপ্ত সাহার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছে পুলিশ।
মামলা দুটির এজাহারে বর্ণিত বিবরণ অনুযায়ী, আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। তবে, আসকের প্রতিনিধি দলের কাছে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, পরিবারের সঙ্গে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রশাসন বা পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ কখনও যোগাযোগ করেনি।
তথ্য অনুসন্ধানকালে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৬ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ২৪ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১ জন সাধারণ নাগরিক এবং দুজন পুলিশ সদস্য এবং অপর একজন হামীম, যিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চালক। উল্লিখিতদের মধ্যে গুরুতর আহত ছিলেন—রমজান মুন্সী, আব্বাস আলী ও সুমন বিশ্বাস নামের তিন তরুণ, যাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে রেফার করা হয়।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আসকের প্রতিনিধিদের জানান, ১৬ জুলাই দুপুর থেকে মোট ৪ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তাদের ‘ব্রড ডেথ’ ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। অপরদিকে নিহত দীপ্ত সাহাকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত দুজন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কাছে দাবি করেন, যখন দীপ্ত সাহাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন দীপ্ত সাহা বেঁচে ছিলেন এবং তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরকম অবস্থায় দীপ্ত সাহাকে অপারেশন থিয়েটারেও নিয়ে যাওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে কিছু সময় পরে ডাক্তার দীপ্ত সাহাকে মৃত ঘোষণা করেন। কাজেই ‘ব্রড ডেথ’ ঘোষণা করার কথাটা ঠিক নয়।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে আসক প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছিলেন আহতদের মধ্যে মোট কতজন গুলিবিদ্ধ ছিলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঠিক এভাবে বলা যাবে না, গুলির বিষয়টি বলতে হলে আরও এক্সামিনের ব্যাপার রয়েছে।’ তবে তিনি আসকের প্রতিধিদের নিশ্চিত করেছেন আহত পুলিশ সদস্য মিনহাজ সরদার ও মো. কাওছার হোসাইন এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক হামীম; তাদের মধ্যে কেউ গুলিবিদ্ধ ছিলেন না।
গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে দায়িত্বরত জেল সুপার তানিয়া জামান এবং কারাগারে উপস্থিত এআইজি (প্রিজন) দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম ২১ জুলাই আসক প্রতিনিধিদের জানান, এ পর্যন্ত ১৮ জন শিশুকে আদালতের আদেশে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে ১০০ বন্দিকে পিরোজপুর এবং ৫০ বন্দিকে বাগেরহাট কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ১৫০ বন্দির সবাই হাজতি। এই কারাগারে বন্দির মোট ধারণ ক্ষমতা ৩৪৮; এর মধ্যে পুরুষ ৩২১ ও নারী ২৭। ২১ জুলাই মোট বন্দী ছিলেন ৭৫১ জন।
অন্য জেলার কারাগারে বন্দী স্থানান্তরের কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, যখন ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বন্দী বেশি হয়ে যায় তখন বন্দীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এ রকম বিধান রয়েছে। আমরা বিধি অনুসরণ করেই পদক্ষেপ নিয়েছি।
কারা কর্তৃপক্ষ আসক প্রতিনিধিদের আরও জানান, ১৬ জুলাই আনুমানিক দুপুর ৩টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কারাগারে হামলা করে। হামলায় কারাগারের সীমানাপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে, গার্ডরুম, গেস্ট ওয়েটিং রুমের ক্ষতি করে। কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। এছাড়া কারাগারের অস্ত্রভাণ্ডার ভাঙার চেষ্টা করে। এই ঘটনায় কারা পুলিশ ৮০ রাউন্ড ‘মিসফায়ার’ করে। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। কারা কর্তৃপক্ষ সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহরের উত্তেজনা অনুধাবন করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সব বন্দিকে লকআপে নিয়ে নেয়। পূর্ব সতর্কতার জন্য কারাগারে কোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আসকের প্রতিনিধিরা, গোপালগঞ্জ সদর থানায় তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। পুলিশ সুপার গোপালগঞ্জ আসকের প্রতিনিধিদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানান, ‘১৬ জুলাই সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে তা এক কথায় তীব্র। পুলিশ কোনও মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি বরং সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেছে হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে এনসিপি নেতাদের আমার কার্যালয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি আমার অফিসে নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করতে হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। আমরা হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে কিছু ব্যক্তিকে ৫৪ ধারাতেও আটক দেখানো হয়েছে। ২০ জুলাই পর্যন্ত মোট ৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। কারাগার এবং সরকারি সম্পত্তিতে হামলার ঘটনায় এখনো মামলা দায়ের হয়নি, তবে কারাগার কর্তৃপক্ষ মামলা করবে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা, গোপালগঞ্জে দায়িত্বরত সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ করতে পারেনি। তবে ২২ জুলাই গোপালগঞ্জ শহরের ডিসি অফিসের সন্নিকটে ডিউটিরত কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন সাকিবের সঙ্গে আসক প্রতিনিধিরা কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি জানান, ‘তিনি ভিআইপি ডিউটিতে আছেন, এখন কথা বলা সম্ভব নয়। ফোন নাম্বার দিয়ে তিনি পরে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন। আসকের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।’
কালের আলো/এমএএইচএন