এনসিপি নেতাদের জীবন রক্ষায় সেনাবাহিনী ছাড়া কেন কেউ এগিয়ে আসেনি?
প্রকাশিতঃ 11:16 pm | July 17, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ এবং পূর্ব ঘোষিত। বুধবার (১৬ জুলাই) সেই সমাবেশেই দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওপর হামলাসহ নাশকতা ও সহিংসতা চালায় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এই নাশকতা ও সহিংসতায় প্রাণ গেছে চারজনের। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো হয়েছে কারফিউ এর সময়। সেনাবাহিনীর সাজোয়া যান এপিসিতে করে সেদিন নিরাপদে গোপালগঞ্জ ছাড়েন এনসিপি নেতারা। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় সন্ধ্যায় তাঁরা খুলনায় পৌঁছান এবং সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেন। এনসিপির শীর্ষ নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু দলটির নেতাদের জীবন রক্ষায় কেন অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা কেন এগিয়ে আসেনি সেই প্রশ্ন মোটাদাগে সবার সামনে এসেছে। সেনাবাহিনী অসম সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে না হলে মহাবিপদ ঘটতে পারতো বলেও মনে করছেন অনেকেই।
দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা দু:সময়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে বারবার। গোপালগঞ্জে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এনসিপির নেতাদের নিরাপদে উদ্ধারের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের ‘আস্থার প্রতীক’ বিশেষণের মর্যাদা রেখেছেন। আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা দেশবাসীর কাছেও প্রশংসিত হয়েছেন। চরম বাস্তবতায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও আওয়ামী লীগ সমর্থক গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনাবাহিনীকে নিয়ে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। অতীতেও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কেন ক্ষমতা নিচ্ছেন না, জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে না এমন সব প্রশ্ন রেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে দলটির কর্মী-সমর্থকরা। এখন গোপালগঞ্জে সংঘাতে চারজন নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীকে টার্গেট করেই নানান অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। তবে সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হয় বলে জানিয়েছে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁরা এ ঘটনায় গুজব বা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে ধৈর্য ধারণ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।
গোপালগঞ্জে চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় জেলাটির জনসাধারণ অত্যন্ত ধৈর্যর সঙ্গে নিজেদের নিবৃত্ত রেখে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন বলেও আইএসপিআর এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের কারণও তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারংবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর ওপর বিপুলসংখ্যক ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ে হামলা করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অতঃপর সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিদের খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। সর্বোপরি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পেশাদারি ও ধৈর্যের সাথে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।’
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল থেকে শুরু করে দেশের সংকটময় এই সময়ে দেশ রক্ষাসহ প্রতিটি কার্যক্রমে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে চলেছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। সংকটে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর এসব ভূমিকার উদাহরণও কম নয়। গোপালগঞ্জের ঘটনার আগে গত বছর ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে হাসনাত আবদুল্লাহসহ ৫০ জন শিক্ষার্থী আন্দোলনরত আনসার সদস্যদের হামলার শিকার হন। সে সময়ও সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যায়। হাসনাত আবদুল্লাহসহ গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকার সিএমএইচে ভর্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেড় মাস আগেও এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম সেনাবাহিনীর অবস্থান ও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রংপুরে জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘পুরোনো বাইক আর সামান্য আগুন নিয়ে যাদের এত চিন্তা তারা বিগত ৯ মাসে আওয়ামী সন্ত্রাসী খুনিদের ধরতে কয়টা অভিযান চালিয়েছে? কতজনকে গ্রেপ্তার করেছে?’
এর আগে একটি নন ইস্যুকে ইস্যু করে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে ইঙ্গিত করে ফেসবুক পোস্টে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। দলটির আরেক নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী হাসনাতের ওই স্ট্যাটাসকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। এই বিষয়ে সেনা সদর দপ্তর আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিক্রিয়া না জানালেও সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজপোর্টাল নেত্র নিউজে সেনাসদরকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলেছিল-‘হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়’। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনা পরিক্রমায় সেনাবাহিনীকে তথা সশস্ত্র বাহিনীকে জড়িয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের কারও কারও একতরফা ও একপক্ষীয় অভিযোগ আর কল্প-কাহিনী ফাঁদার তোড়জোড় বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠেছে।
অথচ জুলাই-আগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান স্বার্থক উপসংহারে পৌঁছে দিতে লাশের সারিকে আর দীর্ঘ না করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অসীম সাহস ও দূরদৃষ্টিতে কালজয়ী এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। ঐতিহাসিক এক বাঁকবদলে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকে সঙ্গে নিয়ে ‘টিম ওয়ার্ক’ এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ফয়সালা করেছেন। বিস্মৃতিপ্রবণ বলেই কীনা অনেকেই হয়তো সেটি বেমালুম ভুলে গেছেন!
গোপালগঞ্জ সংঘাত, কী বলছেন দুই উপদেষ্টা?
আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ ও স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সুলুক সন্ধান শুরু হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও তাঁরা বড় রকমের সহিংসতার মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থানকে জানান দিয়েছেন। এনসিপির সমাবেশটি পূর্ব ঘোষিত হলেও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগাম যথাযথ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এবং ব্যাপক জনসমাগম না ঘটলেও এনসিপি সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় সংঘবদ্ধ হয়েই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা কয়েক দফা তাদের ওপর হামলার দু:সাহস দেখিয়েছে। স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের কাছ থেকেও এনসিপি কোন রকম সহযোগিতা পাননি। ফলে সুযোগ বুঝে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে নামতে পেরেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রুদ্ধশ্বাস এই পরিস্থিতির সময়ে এনসিপির অবরুদ্ধ নেতাদের জীবন রক্ষায় অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নেতারাও এগিয়ে আসেননি। ফলে নিষিদ্ধ দলটির তাণ্ডব-সহিংসতার দায় কোন পক্ষই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিবৃতি ছাড়া এনসিপিকে রক্ষায় কোনো দলই এগিয়ে আসেনি, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবির এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর যখন ভয়াবহ আক্রমণ হলো, পরে সব রাজনৈতিক দলকে তাদের পক্ষে বিবৃতি দিতে দেখেছি। কিন্তু ঘটনাস্থলে এনসিপিকে রক্ষা করার জন্যে বা তাদের প্রতি সমর্থন হিসেবে অন্য কোনো সংগঠন এগিয়ে আসেনি।’ সঠিক সময়ে সঠিক কথাটিই বলেছেন দেশবরেণ্য এই সাংবাদিক।
গোপালগঞ্জের অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতি এড়াতে কেউ কেউ আগাম বাড়তি সতর্কতার অভাবকেই মোটা দাগে দায়ী করেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজেও স্বীকার করে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে বুধবার যে ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে এত পরিমাণ যে হবে, ওই তথ্য হয়তো ছিল না।’ অনেকেই পুরো পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অভিযোগের তীর ছুঁড়লেও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া সেটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে তা দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো ভূমিকা পালন করেছে। তারা সফলভাবে ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যেককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। ফলে বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই।’
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরাও দেখেছি সবাই যেখানে কথার ফুলঝুরি ফোটোচ্ছেন সেই সময়ে গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাদের উদ্ধার করে নিরাপদে খুলনা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে প্রতিটি সংকটে দেশের মানুষের প্রধান ভরসার জায়গায় রয়েছেন তাঁরাই। অতীতেও দেশের প্রতিটি দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নানাবিধ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতে সফল গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড.মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অচল করতে আনসার বিদ্রোহ, দাবি-দাওয়ার অজুহাতে নানা আন্দোলন, পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতার ঘটনা ঘটে। মববাজি ও সড়ক-মহাসড়ক অবরোধও নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কঠিন মুহুর্তে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ প্রতিটি পরিস্থিতি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলায় চরম ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। দেশের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ হাজারো স্রহস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে চড়াই-উতরাই ভেঙে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকে সশস্ত্র বাহিনী গত ১১ মাসে প্রমাণ করেছে দেশের স্বার্থেই তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ। ‘সবার আগে দেশ’ এই নীতিতেই তাঁরা বিশ্বাসী। ফলে দিনের শেষে সশস্ত্র বাহিনীর গভীর দেশপ্রেম, দায়িত্বশীলতা, সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়েছে।
কালের আলো/এমএএইচএন