অস্তিত্ব জানান দিতে আ.লীগের বেকার নেতারা ছুটছে ভুঁইফোড় সংগঠনে
প্রকাশিতঃ 10:04 pm | March 13, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ এবং দলের বিভিন্ন পদধারী বেকার আওয়ামী লীগ নেতারা রাজধানীর কয়েকটি ভুঁইফোড় সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদেরকে দেখা না গেলেও ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, প্রধান বক্তা কিংবা বিশেষ অতিথির আসনে দেখা যায়। তবে সেই ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তারাই নাকি এমপি-মন্ত্রী বানিয়ে থাকেন। তারা কিছু হতে না পারলেও তাদের সংগঠনের মাধ্যমে অনেকেই হয়েছে মন্ত্রী বলে দাবি করছেন।
সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন।
যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির রয়েছে মাত্র ছয়টি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। এরপরও অনুমোদনহীন ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো নিজেদের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাবি করে। আর সেই সংগঠনের পক্ষেই কাজ করছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নাম ধারী নেতা।
তারা সেই সংগঠনগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হচ্ছেন। কথা বলছেন দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও। আলোচনা সমালোচনা করছেন দলের এবং বিরোধী দলের কার্যকলাপ নিয়ে। আবার পাল্টা বক্তব্যও রাখছেন বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের পাল্টা।
আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, দলের অনেক নেতাই মন্ত্রী কিংবা এমপি হওয়ার যোগ্যতা জাহিরের স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে থাকেন ভূঁইফোড় সংগঠনকে।
নিজেদেরকে যোগ্য নেতা তৈরী করে থাকেন এই সংগঠনের মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। সেখানে সবাইকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকে না। তাই ভুঁইফোড় সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা বক্তব্য রাখেন। এই ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো প্রেসক্লাবের ভিতরে কিংবা বাহিরে অনুষ্ঠান করে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্যই হলো মিডিয়া কাভার। মিডিয়া নির্ভর এই ভূঁইফোড় সংগঠনগুলো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভুঁইফোড় এসব সংগঠনকেই বিভিন্নভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ সাবেক ও বর্তমান কিছু মন্ত্রী। দিবস ভিত্তিক অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য নানা ছুঁতোয় সেমিনার বা আলোচনা সভার আয়োজন করে ওই চক্র। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বা মন্ত্রীদের প্রধান অতিথি করা হয়। নেয়া হয় আর্থিকসহ নানা সুবিধা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠন ছাড়া বেশিরভাগ সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যন্ত নেই। নেই কোনো গঠনতন্ত্র ও কার্যালয়। কাগজে-কলমে ছাড়া বাস্তবে এসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এমনও রয়েছে, এক ব্যক্তিই দু-তিনটি সংগঠন খুলে বসেছেন। একই ইস্যুতে একেক দিন একেক সংগঠনের নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তারা। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারীরা হন ভাড়া করা।
এজন্য ঘুরেফিরে একই লোকদের দেখা যায় প্রায় প্রতিটি সংগঠনের অনুষ্ঠানগুলোতে। সংগঠনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অতিথি করা হয়। একই সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের নেতা ও ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা নিয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বা সভাপতিত্ব করানোর অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। আর এর মাধ্যমেই অনেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছের মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করে নানা ধরনের সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালান।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের নামেই প্রায় শতাধিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি রয়েছে রাজনৈতিক দল হিসেবে।
তার মধ্যে-জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হর্কাস লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিক্সা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হর্কাস লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতকি জোট, বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ।
বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু গবষেণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আর্দশ পরিষদ, আমরা মুজিব সেনা, আমরা মুজিব হবো, চেতনায় মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ।
ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, বাংলাদশে আওয়ামী পর্যটন লীগ, ঠিকানা বাংলাদেশ, জনতার প্রত্যাশা, রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, জননেত্রী পরষিদ, দেশরত্ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, আমরা নৌকার প্রজন্ম, আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, তৃণমূল লীগ, একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি, আওয়ামী প্রচার লীগ।
আওয়ামী লীগরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে ছাত্রলীগ ও শ্রমকি লীগ।
দলের গঠনতন্ত্রে এ ধরনের কোনও সংগঠনের ভিত্তি নেই।
দিনেদিনে বেড়ে চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে নাম সর্বস্ব সংগঠন। এসব নাম সর্বস্ব সংগঠনের পেছনে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার ছাড়াও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নামও ব্যবহার করছেন উদ্যোক্তারা। এমনকী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করেও অনেক সংগঠন গড়ে উঠছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন মূলত লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন-সর্বস্ব। বাস্তবে এসব সংগঠনের কোনও কাযক্রম যেমন নেই, তেমনি নেই কোনও কার্যালয়ও।
আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠন এখন রাজনৈতিক আদর্শগত ভাবে তারা মূল ধারার রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তারা যদি কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায়, সেখানে যাওয়া কিন্তু আমি অপরাধ দেখি না।
কালের আলো/এমএইচএ