শেষ হচ্ছে ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতার সময়সীমা, সেনাবাহিনীকে আরও বেশি সময় মাঠে চায় দেশের মানুষ

প্রকাশিতঃ 2:06 pm | November 13, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই কারফিউ জারি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন থেকেই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে আসছে সেনা সদস্যরা। পুলিশের মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা না হওয়ায় এবং দেশে অরাজকতা ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীকে ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। প্রজ্ঞাপনে ৬০ দিনের কথা উল্লেখ করা হয়। দ্রুতই শেষ হতে যাচ্ছে এই সময়সীমা।

অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠেছে, আর কতদিন পর্যন্ত মাঠে থাকবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, কী হবে তাদের ক্ষমতার পরিসীমা? এসব বিষয়ে সরাসরি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী কত দিন মাঠে থাকবে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বুধবার (১৩ নভেম্বর) সকালে ঢাকা সেনানিবাসে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই কথা বলেন। অপরাধ দমন, অপরাধীদের গ্রেপ্তার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার সামগ্রিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি অস্ত্র, ২ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আড়াই হাজার ব্যক্তিকে।’

সেনাবাহিনীকে আরও সময় মাঠে চায় দেশের মানুষ
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা তিনদিন সরকারবিহীন ছিল দেশ। এ সময়টিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ভেঙে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন। ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে উধাও হয়ে যায় পুলিশ। সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই পুলিশি ব্যবস্থা পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করে। ভীতিকর অবস্থা ও নৈরাজ্য বন্ধে বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট ঘোষণা দেন কোনভাবেই এই অন্তবর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় পাশে থাকবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

  • সেনা সদরের সংবাদ সম্মেলন
  • ৬ হাজারের বেশি অস্ত্র ও ২ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার
  • দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ছয়শর বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ
  • বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে সেনাবাহিনী সচেতন
  • সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর কমেছে অপরাধের সংখ্যা

পরবর্তীতে সেনা সদস্যদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতায় রাজধানীসহ দেশের জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সহিংসতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকাও হতে থাকে সচল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশের থানাগুলোতে চালু হয় পুলিশী কার্যক্রম। শিল্পাঞ্চলে নাশকতা-অস্থিরতা চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিকে নিয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর শক্ত কাঠামোর মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলে প্রাণান্তকর প্রয়াস। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবশেষে গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করে সরকার। দেশের দু:সময়ে ত্রাণকর্তা ও নির্ভরতার প্রতীক দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ায় জনমনে পুরোমাত্রায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করে। অন্তবর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী ও ইতিবাচক হিসেবেই মনে করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ। গত প্রায় দু’মাসে সেনাবাহিনী কোনভাবেই যেন মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে নিজেদের দায়িত্ব পালনে পুনরায় সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করেছে। দেশের মানুষ এখনও মনে করেন, দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে আপোসহীন, সৎ-নির্ভীক এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোমাত্রায় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী ও ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনতে সেনাবাহিনীকে মাঠে আরও সময় থাকতে হবে। এ বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকে ভেবে দেখার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন বিশ্লেষকরা।

সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে এটি সরকারের সিদ্ধান্ত
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে সেনাসদরের কর্নেল স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার বলেন, ‘সেনাবাহিনী প্রশাসনকে ৬০ দিন সহায়তা করতে এই তথ্যটি সঠিক নয়। ৬০ দিনের জন্য নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কত দিন থাকব এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। কারণ সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তে, সরকারই এটা নির্ধারণ করবে কত দিন মোতায়েন থাকা প্রয়োজন। সেনাবাহিনী দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নিয়োজিত রয়েছে।’

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সেনাবাহিনী অত্যন্ত সচেতন। এই ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দিষ্ট আদেশ রয়েছে যে, কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে যেন আমরা-সেনাবাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হতে না দেই, সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এটা প্রতিরোধ করার,- যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে এই ধরনের (মানবাধিকার লঙ্ঘন) কোনো যেন ঘটতে না দেই। যে ঘটনাগুলো ঘটছে আপনারা সেগুলো জানতে পারছেন। এর বাইরে আমাদের কার্যক্রমের কারণে কতগুলো পরিস্থিতিতে এই ধরনের কোনো কিছু প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, এটা হয়তো অনেক সময় জনসম্মুখে আসে না।’

‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে এই পর্যন্ত ছয়শর বেশি আনরেস্ট হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ভায়োলেন্ট ছিল। অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নিয়ে এগুলো যদি সময়মত প্রতিরোধ বা শান্ত করার ব্যবস্থা না করা হত, তাহলে অনেক বেশি ঘটনা ঘটতে পারত।’

সেনা সদস্যরা এক ব্যক্তিকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন-এমন একটি ভিডিওর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, ‘পরিস্থিতির প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে হয়, তবে সেনাবাহিনী টার্গেট করে কাউকে মেরেছে এমন কোনো ঘটনা হয়নি।’ পুলিশের কাছে অপরাধের যেসব তথ্য থাকে, সেগুলো নিয়েও সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে জানান এই সেনা কর্মকর্তা।

সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর অপরাধের সংখ্যা ‘অনেক কমেছে’
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর অপরাধের সংখ্যা ‘অনেক কমেছে’। ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি, তবে যতটুকু আশা করা গেছে সে অনুযায়ী উন্নতি হয়নি। পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে। অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে’-বলেন কর্নেল ইন্তেখাব।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, গুলশানে একজন মেজরের সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মকর্তার ঘটনাটি ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ‘খুবই ভালো’। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্যই সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

‘জনগণের জানমাল, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে রক্ষা করার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীকে পুনরায় কার্যক্ষম হতে সহায়তা করে আসছে সেনাবাহিনী।’ বিদেশি কূটনীতিক, দূতাবাস ও কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার কাজটিও সেনাবাহিনী করছে বলে জানান তিনি।

‘দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ছয়শর বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং কারখানাগুলোকে চালু করতে সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে-জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত দুই মাসে সাতশর বেশি বিভিন্ন ধরনের ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪১টি, সরকারি সংস্থা/ অফিস সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ৮৬টি, রাজনৈতিক দলের ঘটনা ছিল ৯৮টি।’ গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা যেন ‘সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে’ প্রয়োগ করা হয়, সে বিষয়ে সেনাবাহিনী সতর্ক আছে বলে জানান কর্নেল ইন্তেখাব। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের ৬২ জেলায় সেনা সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করছে। বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে আহত ৩২৯৫ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৪৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন।’

কালের আলো/এমএএএমকে