কেন গুজবের প্রধান টার্গেট সশস্ত্র বাহিনী?

প্রকাশিতঃ 11:13 pm | July 23, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

গোধূলির আবছা আলোয় সেদিন উত্তরের আকাশ যেন এক মৃত্যুপুরী হয়ে নেমে এসেছিল। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের প্রাঙ্গণ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল এক বিভীষিকাময় ধ্বংসস্তূপে। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন আর বাতাসে পোড়া গন্ধ-এসবই যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো গ্রাস করেছিল পুরো দেশকে। এই মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা শুধু কিছু প্রাণের বিনিময়ে শেষ হয়নি, বরং আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এক নির্মম বাস্তবতা। এই হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের কি শিক্ষা দিল, তা গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে যেমন ভেবে দেখার প্রয়োজন। ঠিক তেমনি ঘটনার পরপরই কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবতীয় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কেন তাদেরকে নিয়ে অপতথ্যের তাণ্ডবের মাধ্যমে আমরা কেমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছি এই বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়েই ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের প্রতিটি দুর্যোগে-সংকটে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী অতীতেও একইভাবে বিবেকের দায়বদ্ধতা ও দেশপ্রেম থেকেই এমন দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সেদিন থেকেই লাশ লুকানো নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এটি জনগণের মধ্যেও মারাত্মকভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করে। দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনীর প্রাণান্ত প্রয়াস যেখানে প্রশংসার দাবি রাখে সেখানে তাদেরকে টার্গেট করে নানাবিধ গুজব-অপপ্রচার ছড়িয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক প্রকার আস্থাহীনতা তৈরির অপপ্রয়াস দৃশ্যমান হয়েছে।

অথচ উদ্ধার কার্যক্রম থেকে শুরু করে মৃতের সংখ্যা যাবতীয় বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও সশস্ত্র বাহিনী স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে। দ্রুততার সঙ্গেই তাঁরা সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। লাশের সঠিক সংখ্যা, তাদের পরিচয় এবং উদ্ধার কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপ জনগণের সামনে দিবালোকের মতো পরিস্কার করে তুলেছে। এরপরও এ বিষয়ে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো শুধু জনমনে অবিশ্বাস তৈরি করবে না একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই স্তম্ভকে দুর্বলও করবে। এসব বিষয়ে প্রত্যেককে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রদান করতে হবে। কিন্তু আমরা সেই পথে না হেঁটে ‘চিলে কান নিয়েছে’ এই প্রবাদ বাস্তবায়নেই যেন কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছি।

ভুল তথ্য আর যাচাই-বাছাই ছাড়া স্পর্শকাতর এই সময়ে এই ধরণের তথ্য না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দিবাগত রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ফারুকী বলেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত অভিনেত্রী, অভিনেতা, পরিচালক গত তিন ঘণ্টায় তাদের প্রোফাইল থেকে একটা ভুল তথ্য পোস্ট করেছেন, যার হেডিং ছিল ‘মাইলস্টোনের ওপর বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যাদের পাওয়া যাচ্ছে না!’ তার মধ্যে একজনের পোস্ট ১৩০০ বারের বেশি শেয়ার হয়েছে। তিনি এটা ডিলিট করেছেন একটু আগে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘ভুয়া তথ্যে বলা হচ্ছে, মাইলস্টোনের প্রায় ৪৬ ছাত্র-ছাত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই রকম অবিশ্বাস্য কথা কি ভুল করে উনারা শেয়ার করলেন? নাকি এটা একটা সম্মিলিত উদ্যোগ? এ রকম ট্রমাটিক (আঘাতজনক) একটা বিষয় নিয়ে এমন দায়িত্বহীন পোস্ট সত্যিই দুঃখজনক।’ সতর্কবার্তা দিয়ে ফারুকী বলেন, ‘মাইলস্টোনের ক্লাসে কারা ছিল, কারা প্রাণ হারিয়েছে, কারা চিকিৎসাধীন-এই সবই তো রেকর্ডেড। সুতরাং দয়া করে ভুয়া হেডলাইন দেওয়া লেখা শেয়ার করে মানুষকে আরও ট্রমাটাইজড করবেন না। জাতি শিল্পীদের কাছে আরেকটু দায়িত্বশীলতা আশা করে।’

বুধবার (২৩ জুলাই) দিনমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকা পর্যবেক্ষণের পর কথা হয় স্থানীয় দোকানি হাসান আহমেদ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দিনে প্রচণ্ড রোদ এবং অনেকের কাজ থাকায় বিকালে মানুষের এমন চাপ দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’ এ সময় দেখা যায়, অসংলগ্ন তথ্য উপস্থাপন করে ভুঁইফোড় গণমাধ্যমগুলোর কতিপয় প্রতিনিধি যার-তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। কেউ বলছেন ৩০ জন মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন কয়েকশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এতে নানা ধরনের বিভ্রান্তি বাড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানে অবস্থানরত একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান, প্রশাসন বা সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ থাকলে ঘটনাস্থলে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করতো না। বিশেষ করে নামসর্বস্ব গণমাধ্যমগুলোর দৌরাত্ম্য কমতো। এ এইচ নোমান রেজা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনেক ইউটিউবার ও ফেসবুক লাইভ থেকে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মনগড়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এসব তথ্য কেউ বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।’

গত দু’দিনে সশস্ত্র বাহিনীকে টার্গেট করে এসব ঘটনায় নানা আপত্তিকর স্লোগান ও প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে মর্জি-মাফিক। কাণ্ডজ্ঞানহীন এমন প্রবণতা দৃষ্টি এড়ায়নি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই প্রতীক এই বাহিনীটিকে ঘৃণ্য কায়দায় হেনস্থার অপপ্রয়াসও দৃশ্যমান হয়েছে। অথচ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘লাশ লুকানোর গুজব’ দেশবাসীকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত-নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।’

একই রকম কথা বলেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা গোপন করার কোনো ‘প্রয়োজন বা অভিপ্রায় সরকারের নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা ‘গোপন রাখা অসম্ভব’ বলেও মনে করেন তিনি। দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাঠের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারণা তিনি পোষণ করেন বলে জানিয়েছেন।

একই বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী বলেছেন, ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কোনো তথ্য গোপন করার ইচ্ছা বা প্রয়াস সেনাবাহিনীর নেই। তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেকেই না বুঝে এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন। ঘটনার পরপরই কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে দ্রুত সাড়া দিয়েছে, যেমনটি সবসময় করে। এ বিষয়ে কোনো তথ্য গোপন করার ইচ্ছা বা প্রয়াস আমাদের নেই। আমি নিজে ও আইএসপিআর টিম সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘অতএব আইএসপিআরের পরিচালক হিসেবে আমি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি, যে কোনো গণমাধ্যম চাইলেই এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে, সেনাবাহিনীসহ যে কাউকে ইন্টারভিউ করতে পারে বা সংশ্লিষ্ট যে কোনো স্থান পরিদর্শন করতে পারে। আমরা সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে প্রস্তুত এবং আপনাদের যে কোনো প্রয়োজনে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা হবে।’

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে