মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: গুজব-প্রশ্ন-উত্তরে বিমর্ষ-বিহ্বল দেশ

প্রকাশিতঃ 11:53 pm | July 23, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের তিন শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান উমাইর, মাহিদ হাসান আরিয়ানও (১১) ও বাপ্পি সরকারও (১০)। না ফোটা ফুলকুঁড়ি। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাদ জোহর এই তিন শিশুকে একসঙ্গে দাফন করা হয়েছে পারিবারিক কবরস্থানে। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে একই বংশের তিন শিশুকে হারায় দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদপাড়ার তিন পরিবার। জীবন থেকে ছুটি নিয়ে ওদের অকালেই অনন্তযাত্রা। পরিবারগুলোতে কেবলই শোকের মাতম। শুধু এই শিশুরাই নয়, আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে যারা; মিলেছে যাদের মৃত্যুর ছাড়পত্র; সেইসব শিশুদের অঙ্গার নিথর দেহ নিয়ে বাবা-মা ও স্বজন-পরিজন ফিরেছে ঘরে; শুইয়ে দিয়েছে শান্ত কবরের কোমল মাটিতে। তাদের বিদায়ে কেঁদেছে গ্রাম-শহর, শোকে ঢুকরে উঠেছে জাতির হৃদয়। আর চামড়া পোড়ার যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করা শিশুদের জন্য দোয়া করছে দেশ; তাদের জীবিত ফেরার অপেক্ষায় সবাই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে শোকের এই ছায়া পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তেও। এতগুলো কোমলমতি শিশুর প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়া কেউ মানতে পারছে না। সন্তান কিংবা স্বজনহারা পরিবারগুলোও শোকে স্তব্ধ। তাদের বুকের ওপর এখন কেবলই কান্নার জমাট পাথর।

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির তৃতীয় দিনেও বুধবার (২৩ জুলাই) লাশের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন-উত্তরে বিমর্ষ-বিহ্বল ছিল দেশ। গুজব হানা দিয়েছে ডানা মেলে অসহ্যভাবে। আর করণীয় খুঁজতে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত রয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস টানা দু’দিন দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। এদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সরেজমিনে স্কুল এলাকায় যাওয়ার পর মাহমুদা চৌধুরী নামে ভুক্তভোগী এক অভিভাবক বলেন, ‘বাচ্চাদের পুড়ে যাওয়া অংশে হাত দেওয়া যায়নি। আমি হাত দিতে গিয়ে দেখি আমার হাতও পুড়ে গেছে। তাহলে এই আগুনের তাপ কিভাবে সহ্য করেছে ওরা। বিমানের জ্বালানির আগুনের তাপ অনেক অনেক বেশি। শুধু আমি না, যারাই পুড়ে যাওয়া শিশুকে ধরতে গেছে তারাই পুড়ে গেছে। এমন শক্তিশালী আগুন আমি জীবনেও দেখিনি।’ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মূলত স্কাই, অলিভ, ব্লু ও ক্লাউড সেকশনে ভাগ করে পাঠদান করানো হয় সেখানে। স্কাই ও অলিভ সেকশনটি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। স্কাই ও ব্লু সেকশনের বাচ্চারা বেশি হতাহত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহত ২৯ জন। এর মধ্যে ২২ জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে এই হালনাগাদ তথ্য জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, নিহতদের মধ্যে ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত করে ইতোমধ্যে তাদের পরিবার ও আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ৬ জনের মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এবং অজ্ঞাত ১ জনের মরদেহ লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারের মর্গে সংরক্ষিত আছে। এসব মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম চলমান আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, বুধবার (২৩ জুলাই) ১১ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন এবং একজন নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হাসান মো. মঈনুল আহসান সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটিতে স্বাক্ষর করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আইএসপিআর এর সঙ্গে সমন্বয় করেই এই তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছে।

  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিমান বাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ
  • স্বজনদের বুকের ওপর কেবলই কান্নার জমাট পাথর
  • নাজিয়া ও তার ছোট ভাই পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে
  • নিহতদের মধ্যে ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালানাগাদ তথ্য বলছে, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪৫ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৯ জন, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন এবং হিউম্যান এইড রিসার্চ ল্যাব অ্যান্ড হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। তথ্য বলছে, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে ১২ জন এবং উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে একজন ছাড়া পেয়েছেন। আর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নতুন করে একজন ভর্তি হয়েছেন। আর নিহতদের মধ্যে ১১ জন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে, ১৫ জন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ), একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, একজন লুবানা জেনারেল হাসপাতালে এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।

আইএসপিআর এর সঙ্গে তথ্যে গড়মিল কেন হচ্ছে? এর ব্যাখ্যায় প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল থেকে একজনের মৃতদেহ সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। সেই সংখ্যাটি নিয়ে আমাদের তথ্যের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। আমরা বলেছি ১৫ জন, সিএমএইচে ১৫ জনের মৃতদেহ আছে। যদিও আইএসপিআরের তথ্যে ১৬ জন বলা আছে। তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে একটু সময় লাগবে। এছাড়া আইএসপিআরের তথ্যে লুবানা হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই হাসপাতালের তথ্য সম্পর্কে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের রেজিস্ট্রিতে কোথাও মৃত্যু নেই। কিন্তু তারা মুখে বলছে, দুই জনকে মৃত অবস্থায় তাদের অভিভাবকেরা নিয়ে এসেছিলেন। ওই দুই জনের নাম পরে কোনও হাসপাতালে আসেনি।

মাইলস্টোনে উৎসুক জনতার ভিড়ে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। উৎসুক মানুষের চাপে যেকোনও সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। কারণ সেখানে পরিদর্শন করতে আসা উৎসুক মানুষের সমাগম বাড়ছে। দিনভর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেউ না যাওয়ায় বিরাজ করছে হযবরল অবস্থা। বুধবার (২৩ জুলাই) সন্ধ্যায় সরেজমিন এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভিড় তেমন না থাকলেও বিকাল ৫টার পর মানুষের ঢল নামতে শুরু করে। এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের সড়কে। অপরদিকে সাংবাদিকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। ভেতরে হাতেগোনা কিছু নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও বাইরে তেমন নেই। তাই যে যেভাবে পারছেন বিধ্বস্ত শ্রেণিকক্ষটি দেখার জন্য অনিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন। বিশেষ করে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে টিনের চালায় ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ উঠায় যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন দর্শনার্থীদের কেউ কেউ। উৎসুক জনতার একজন হাসনা বেগম বলেন, আমার এলাকার পার্শ্ববর্তী তারাকান্দার তিন জন শিক্ষার্থী এখানে মারা গেছেন। গত দুদিন আসতে পারিনি। তাই আজ এলাম। বিধ্বস্ত ভবনটির সামনে নিরাপত্তা জোরদার না করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

স্বজনদের কান্না-আহাজারি থামছে না
তিন শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান উমাইর, মাহিদ হাসান আরিয়ানও (১১) ও বাপ্পি সরকারকে (১০) মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাদ জোহর একসঙ্গে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে একই বংশের তিন শিশুকে হারায় দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদপাড়ার তিন পরিবার। মাইলস্টোন স্কুল থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বের এ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক উঠোনে পাশাপাশি তিনটি নতুন কবর। এই তিন শিশু একই বংশের। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। তবে তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়Ñতারা বন্ধু। এক উঠোনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা এই তিন শিশু পড়তো মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে। কিন্তু সোমবার স্কুলটিতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শৈশবেই থেমে গেলো তাদের জীবন।

সরেজমিনে ওই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শোকে মুহ্যমান পুরো এলাকা। কবরগুলোর ঠিক উল্টো পাশের ভবনটিই তারারটেক মসজিদ। সেটার বারান্দায় রাখা লাশ বহনকারী খাটিয়া। তার আশপাশে কয়েকজন চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। দু-একজন মিডিয়াকর্মীর আসা-যাওয়াও দেখা গেলো। সেখানেই কথা হয় মাহিদ হাসান আরিয়ানের আপন চাচাতো ভাই মো. রাসেলের সঙ্গে। রাসেল বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালেও তিনজন একসঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল। কিন্তু ফেরা হয়নি। একের পর এক লাশ হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের বাচ্চারা।’ ‘তারা একসঙ্গেই খেলতো। একসঙ্গেই তাদের জানাজা হলো, একসঙ্গেই কবর হলো,’ বলেন রাসেল।

রাজধানীর বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার। বাইরে অপেক্ষায় থাকা বাবা আবদুর রহিম বলছিলেন, ‘ঘটনার সময় সামিয়াকে নিতে আমি স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। যেখানে আগুন ওখানেই তো আমার মেয়ে, এটি দেখে আমি ভেতরে যাই। নিচতলা থেকে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেই। তখনও বুঝিনি ওর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন কী হবে জানি না।’

আইসিইউয়ের ১৫ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে মাইলস্টোনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারাবি আয়ান। তার বাবা জুনায়েদ আহমেদ ও মা তামান্না আক্তার দুজনই অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। ছেলের এই অবস্থা দেখে তারা বাইরে বসে কেবল চোখের পানি ফেলছিলেন। আয়ানের মামা জায়িদী রায়হান বলেন, ‘ফারাবিদের বাসা মিরপুর ১০ নম্বরে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে স্কুলে আসা-যাওয়া করে ফারাবি। জুনাইনা নামে ফারাবির ছোট একটি বোন আছে। এই করুণ পরিণতিতে তার মা-বাবা টানা কান্না করেই যাচ্ছেন।’

তৃতীয় শ্রেণির সায়মাকে পঞ্চম তলা থেকে সপ্তম তলায় নেওয়া হচ্ছিল। সায়মার শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দুই হাত, দুই পা ও মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে। হাত-পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো সায়মা তার মাকে বার বার বলছিল, ‘মা আমার ভয় করছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। মা মা আমি আর পারতেছি না। আমার হাত উঠাতে পারছি না। আমি উঠে বসব। আমার ক্ষুধা লাগছে।’

ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে থাকা মা তার সন্তানকে বারবার বলছিলেন, ‘বাবা এই তো সুস্থ হয়ে যাবে। উপরে নিয়ে খাবার দিব। লিফট আসলেই আমরা ৭ তলায় যাব। সেখানে গেলে ভালো লাগবে। কান্না করে না বাবা।’ লিফটে করে সায়মাকে নিয়ে উপরে চলে গেলেন স্বজনরা।

হাত-পা ও মুখসহ শরীরের সামনের অংশ পুড়ে গেছে মাইলস্টোনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া হকের। শরীরের ৩৫ শতাংশ দগ্ধ এবং শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে রাখা হয়েছে এইচডিইউতে। ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকা তাসনিয়া কোনো কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে ব্যান্ডেজে মোড়া হাত নেড়ে ইশারায় কী যেন বুঝাতে চায়। তেরো বছরের এই শিক্ষার্থীর বাবা হাফিজ উদ্দিন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছিলেন, ‘চঞ্চল মেয়েটা আমার কাছে গেলে অপলক তাকিয়ে থাকে। বাবা হিসেবে মেয়ের এই অবস্থা আমি কীভাবে সহ্য করব?’

নাজিয়া ও তার ছোট ভাই পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে
‘গতকাল রাতেও আমার ছেলেকে রক্ত দেওয়া হয়। ডাক্তাররা বলছিল জানাবে। কিন্তু জানিয়েছে ছেলে মারা গেছে…। আমার মেয়েটা একদিন আগে চলে গেলো। এর পরদিন রাতে ছেলেও চলে গেলো। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো?’ কথাগুলো বুকে পাথর চেপে বলছিলেন বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত নাজিয়া-নাফির মা। বারবার গলা আটকে আসছিল, হারিয়ে ফেলছিলেন কথা বলার শক্তি। একদিনের ব্যবধানে দুই আদরের ধনকে হারানোর বেদনার কোনো মাপকাঠি হয় না।

১৩ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আশরাফুল ইসলাম দম্পতির কোল আলো করে পৃথিবীতে এসেছিল নাজিয়া তাবাসসুম নিঝুম। নিঝুমের জন্মের চার বছর পর কোলজুড়ে আসে ছেলে আরিয়ান আশরাফ নাফি (৯)। নাজিয়া-নাফির বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়িয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। ভর্তি করেছিলেন দিয়াবাড়ি কামারপাড়া বাসার কাছাকাছি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। নাজিয়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর নাফি পড়তো ইংলিশ ভার্সনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে।

যে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দিনরাত সময় কেটেছে বাবা-মায়ের, আজ তারা নিঃস্ব। পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ। যেন কেউ নেই তাদের সঙ্গে। শোকে পাথর পুরো পরিবার। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিহত নাজিয়ার নিজেরও ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবে। সাদা অ্যাপ্রোন পরে বলতো ‘ভয় নেই, আমি আছি।’ সব ভয়কে জয় করে নাজিয়া ও তার ছোট ভাই পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে।


নাজিয়া-নাফির মা ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেন, ‘ঘটনার দিন দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে ছিল। আমি ওদের বাসায় নিয়ে যেতে স্কুলে যাই। আমি স্কুলের ওয়েটিং রুমে বসে ছিলাম। ছেলেকে (নাফি) বলছিলাম মেয়েকে (নাজিয়া) আনার জন্য। মাঝে মধ্যে ওর বোনকে রিসিভ করে নিয়ে আসতো।’ ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বিমান এসে বিধ্বস্ত হয়। স্কুল থেকে তাদের নিয়ে আর বাসায় যাওয়া হয়নি। গন্তব্য ছিল হাসপাতাল। সেখানেই সব শেষ। সোমবার আহত হওয়ার পর নাজিয়া ও তার ভাই নাফিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেদিনই রাত ৩টার দিকে নাজিয়া মারা যায়। আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকে তার ছোট ভাই নাফি। তবে মঙ্গলবার দিনগত রাত ১২টার দিকে নাফিও পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, ‘উত্তরা বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ নাজিয়ার শরীরের ৯০ শতাংশ বার্ন হয়েছিল। আর নাফির শরীরের ৯৫ শতাংশ ফ্লেম বার্ন ছিল।’

কালের আলো/এমএএইচএন