প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপে নির্বাচনের রোডম্যাপে গুরুত্ব

প্রকাশিতঃ 11:26 pm | October 05, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তৃতীয় দফা মতবিনিময়ে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠিত এই সংলাপে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। শনিবার (৫ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এ সংলাপ শুরু হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার দুই দফা সংলাপ হয়, এটি তৃতীয় দফা সংলাপ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, প্রথমে বিএনপি, পরে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ এবং বাম গণতান্ত্রিক জোট, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ এবং এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে যমুনায় সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি বিএনপি’র
আগামী নির্বাচন কবে হবে, সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংলাপ শেষে শনিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে গলমাধ্যমকে এ কথা জানান তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, ভোটার আইডি কার্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার আইন করা হয়েছিল, তা অধ্যাদেশ জারি করে বাতিলের দাবি জানিয়েছি।

নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। বিতর্কিত কোনও ব্যক্তিকে যেন নির্বাচন সংস্কারে গঠিত কমিটিতে রাখা না হয় তারও দাবি জানায় বিএনপি। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভুয়া, বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনের সব কমিশনারদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।

নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মাস, দিনকাল নিয়ে আমি কথা বলিনি। তারা বলছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তারা সবকিছু দেখছেন। আমাদের দাবিগুলো জনগণের, আমাদের দাবিগুলো তাদেরও।

মনোরম পরিবেশে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের মতামত দিয়ে এসেছি।

তিনি বলেন, আমরা বলেছি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ দিতে বলেছি।

নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মূলহোতা বিচারপতি খায়রুল হক দাবি করে ফখরুল বলেন, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার মূল নায়ক ছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।

প্রশাসনে যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হয়ে কাজ করেছে, সহায়তা করেছে, লুটপাট, অনাচার, অত্যাচার, গুম-খুনের ব্যাপারে তাদের বেশিরভাগই এখনও স্ব স্ব জায়গয় বহাল আছে, তাদের অবিলম্বে সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের আনার কথা বলেছি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিতর্কিত জেলা প্রশাসক কীভাবে নিয়োগ পেয়েছে তা বিএনপি জানতে চেয়েছে। একইসঙ্গে অভিযুক্তদের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি। যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ফিট লিস্ট করতে বলেছি। চুক্তিভিত্তিক কিছু নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে দুই একজন আছেন যারা বিপ্লবের মূল স্পিরিটকে ব্যাহত করছে। তাদের সরানোর কথা বলেছি। গত ১৫ বছরের পদোন্নতিবঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিতে বিএনপি প্রস্তাব করেছে বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বেশিরভাগ নিয়োগই ছিল দলীয় ভিত্তিতে। প্রায় ৩০ জন বিচারক এখনও বহাল তবিয়তে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছি। দলকানা বিচারকদের অপসারণ করতে বলেছি। অতিদ্রুত পিপি-জিপি নতুন করে নিয়োগ করতে বলেছি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের (দুর্নীতি, হত্যা) জামিন দেওয়া হচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। এটা দেখতে বলেছি। ২০০৭ থেকে ৫ আগস্ট (২০২৪) পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলের দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা,গায়েবি, ভুয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাজানো মামলা প্রত্যাহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। বিগত সরকারের মন্ত্রী, সাবেক আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। তারা কীভাব পালাচ্ছেন, কার সহযোগিতায় পালাচ্ছেন। তা দেখার জন্য বলেছি।

তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় আমরা জোর দিয়ে বলেছি, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। সেখানে থেকে তাকে কেন্দ্র করে যেসব প্রচার চলছে, অপপ্রচার চলছে। এ বিষয়ে ভারত সরকারর সঙ্গে আলোচনার জন্য এবং ওই অবস্থা থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে বলেছি। তারা ভারত সরকারকে অনুরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অস্থিরতার চেষ্টা হচ্ছে। বলেছি এটা আরও গভীরভাবে দেখে, কারা এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জিয়াউল আহসান ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। অবিলম্বে সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে বলেছি। এবং ব্যবস্থা নিতে বলেছি। জাতিসংঘের একটি দল এসেছে বাংলাদেশে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সহযোগিতা করছে না সংশ্লিষ্টরা।

তিনি বলেন, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কিছু সনাতনী মানুষ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, অত্যাচার হচ্ছে বলে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। এটা মিথ্যা। এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এটাকে গুরুত্ব সহকরে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।

এর আগে বেলা আড়াইটায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপির প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাউদ্দিন আহমেদ।

মৌলিক কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উপহার দেওয়া যায় সেজন্য মৌলিক কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে যেসব পরামর্শ রয়েছে তা আগামী ৯ অক্টোবর জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে দলটি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

সংস্কারকে এক নম্বরে গুরুত্ব দিচ্ছেন জানিয়ে জামায়াত আমির বলেন, সংস্কারের টাইমলাইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুটি বিষয় দেশবাসীর কাছে চেয়েছি এবং সরকারের কাছে জানিয়েছি। একটা রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের।

শফিকুর মনে করেন, সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। তাই দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গত তিনটা নির্বাচনে জাতি বঞ্চিত হয়েছে। আগামীতে জাতির সামনে একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া মূল কাজ। সেজন্য মৌলিক বিষয়ে তাদের কিছু সংস্কার করতেই হবে।

আমিরে জামায়াত বলেন, আগামী ৯ অক্টোবর জাতির সামনে আমাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরবো। কী কী সংস্কার এই মুহূর্তে প্রয়োজন, কী কী সংস্কার পরবর্তী সময়ে লাগবে, সেই বিষয়গুলো জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।

দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে কথা হয়েছে জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করা যায় এবং সব ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। আমরা আশা করছি, বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে একটা ভালো পর্যায়ে নিয়ে নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে? এটা নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করবো। এটা দেরি হবে না। আমরা সামনে আগাতে চাই। এছাড়া কোনো ধর্মের কারণে যেন মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন না হয় সে বিষয়েও প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে বলে জানান ডা. শফিকুর।

এদিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের জামায়াতের প্রতিনিধি দল যমুনায় যান। প্রতিনিধি দলে ছিলেন- দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।

পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বাম গণতান্ত্রিক জোট
সংলাপে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সব সংস্কার করার দায়িত্ব এই সরকারের না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। আজ থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। অন্যান্য সংস্কারের যে কাজগুলো আছে, সেই প্রস্তাব তারা করে যাবেন এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সেই কাজগুলো করবে। আমরা বলেছি এই সরকারের এমন কোনও কাজ করা ঠিক হবে না, যা মানুষের কাছে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে হচ্ছে আমরা যেই গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করেছি, সে গণঅভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সেই জন্য অনেক কাজ করা যাবে না।

সংলাপে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা বলেছেন, আগের সরকারের মতো এই সরকারও যেন জনগণকে উদ্বিগ্ন করে না রাখে। জিনিসপত্রের দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখনও রোধ হয়নি। এগুলোকে জরুরি কর্তব্য হিসেবে নিতে হবে, কারণ জনগণ যদি আশাহত হয় তাহলে কোনও ভালো কাজ বা সংস্কারের কথা শুনবে না।

সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলেছি, মনে রাখা দরকার, আগে যে সরকার ছিল তাদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদায় করা হয়েছে, এই জন্য যে তারা জনগণকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। আমরা বলেছি, এই সরকার যেন জনগণকে এভাবে উদ্বিগ্ন না করে। ইতোমধ্যে দুই মাস পার হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখনও রোধ হয়নি। আমরা বলেছি এগুলোকে জরুরি কর্তব্য হিসেবে নিতে হবে, কারণ জনগণ যদি আশাহত হয় তাহলে কোনও ভালো কাজ বা সংস্কারের কথা শুনবে না।

তিনি বলেন, তারা বলেছেন অনেকগুলো সংস্কারের প্রস্তাব আসবে। ঐক্যমত্য যতটুকু হবে সেটুকু তারা গ্রহণ করবেন। প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত না করতে আমরা আহ্বান জানিয়েছি। রাজনীতি বন্ধের নামে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, এটা করা যাবে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হত্যার বিচার করতে হবে। তবে আমরা দেখলাম এসব ট্রাইব্যুনালে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলো। দখলবাজদের পরিবর্তে আরেক দখলবাজ হলো। এসব ঘটনা মানুষকে, সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা চাই আপনার একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে যার যার জায়গায় ফিরে যাবেন।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের ধর্মীয় এবং আদিবাসী সংখ্যালঘুরা কেন নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে? এটা ঠিক না। আবার সম্প্রীতি তৈরি করে আগামী দিনে সংখ্যালঘুদের যেই পূজা উৎসব আছে এবং আদিবাসীদের যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ্ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আলী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান।

সংস্কার ও নতুন নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক
গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সংলাপ শেষে বলেন, ‘আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক নির্বাচন, দেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, প্রতিষ্ঠান, আইন সংস্কার এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংস্কার ছাড়া নির্বাচনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর কিছুই নেই। এই দেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সংস্কার ও নতুন নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। একটা কাঠামো তৈরি করা দরকার। জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল হতে পারে। যেখানে অংশীজনেরা বসবেন।’ সাম্প্রদায়িক হামলা, মাজারে হামলা, নারীর ওপর হামলা হচ্ছে উল্লেখ করে সাকি বলেন, ‘এগুলোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রচারণা চলছে, সে ক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা, সামগ্রিকভাবে এ ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। সামনে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাবো।’

শনিবার (৫ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে বসে গণতন্ত্র মঞ্চ। পরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মঞ্চের নেতারা।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। আমরা স্পষ্ট করে আমাদের মতামত দিয়েছি। আমরা বলেছি, সংস্কার আমাদের (রাজনৈতিক দল)। আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না, সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি, যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, সে কারণে সংস্কার প্রয়োজন।’

প্রথম থেকে সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বলে আসার কথা উল্লেখ তিনি বলেন, ‘সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা করবো আমরা। আমরা প্রশাসনের কিছু দুর্বলতা দেখছি, সীমাবদ্ধতা দেখছি। সিভিল পুলিশসহ প্রশাসনে এমন কিছু দেখছি, যা উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো। এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

মান্না বলেন, ‘সংস্কারের একটা শর্তই হলো, সবাই সোটা গ্রহণ করবে। ন্যূনতম ঐক্যের প্রচেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়ে আমরাসহ সব রাজনৈতিক দল সরকারকে সহযোগিতা করবো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, যতদূর পর্যন্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কার করতে পারবো, ততদূর পর্যন্ত আমরা সংস্কার করবো। বাকি যেসব সংস্কার দরকার, তা পরের নির্বাচিত সরকার এসে করবে।’

প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সম্মান সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মানুষের যদি মনে হয়, এই সরকারের লিপ্সা আছে, যদি মনে হয় অতীতের মতো ন্যায়-অন্যায় বাছবে না, অর্থের ধান্দা করবে, যদি দুর্নীতি বেড়ে যায়, তা আপনাদের ওপর বর্তাবে। আপনা বলবেন, জানিনি, বুঝিনি সেটা হবে না। প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা সমাজের একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত কাজ করি। আমরা মনে করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুরো সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের দাবি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের বাজারে ঊর্ধ্বগতির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। পুরনো সিন্ডিকেট আবার যে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছি। তারা বলেছেন, চারটা কাজকে অগ্রাধিকার মধ্যে নিয়েছেন। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। আমরা দেখতে চাই, মানুষ যেন এর সুফল পায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যাতে বন্ধ হয়।’

সাইফুল হক বলেন, ‘সংস্কার কমিশন বরিবার (৬ অক্টোবর) থেকে কাজ শুরু করবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্বের জায়গা দেখা যাচ্ছে, এটা আমাদের ধারণা। সরকার সংস্কার বা যতগুলো উদ্যোগ বলি– সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা অর্গানিক যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে, বোঝাপড়া, সমঝোতার মাধ্যমে সরকার যাতে এগুতে পারে, সংস্কার কমিশন কাজ শেষের পরে কোন কোন কাজগুলো তারা করবেন তা নিয়ে ঐকমত্যের জায়গা আছে। কোনগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ করবে তাও আলাপ আলোচনা করে ঠিক করবো।’

সবার মতামত নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবনার মত হেফাজতে ইসলামের
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে অনেকগুলো কমিশন গঠন হয়েছে। প্রতিটি কমিশন আলাদা আলাদা করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবে। আলোচনার মাধ্যমে তারা তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করবে। সেই প্রস্তাবনা তৈরি হলে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে। তারপরই সবার মতামত নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা কাজ শুরু করবে।

মামুনুল হক বলেন, আমরা বলেছি, শিক্ষা কমিশন বাতিল করা হয়েছে। আরও একটি শিক্ষা কমিশন গত ৩০ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয়েছে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার বিষয়ে। সেক্ষেত্রে কিছু আপত্তির জায়গা রয়েছে। এই কমিশনে এমন ব্যক্তি রয়েছেন যারা বিগত রেজিম সরকারের হয়ে কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, এখানে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার বিপক্ষে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। আমরা এই বিষয়গুলোতে মাননীয় উপদেষ্টাকে আরও সতর্ক থাকার কথা বলেছি। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোনও ধরনের ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেটা বলেছি।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের আমির বলেন, এছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলেছি। বাজার মূল্য যাতে নিয়ন্ত্রণে আসে সে বিষয়ে কথা বলেছি।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করেন দলটির ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা হলেন- মাওলানা শায়খ সাজেদুর রহমান, মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, মাওলানা আবদুল বাসেত আজাদ, মাওলানা সরোয়ার কামাল আজিজী, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. আহমদ আবদুল কাদের, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী, মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা জালালুদ্দিন আহমদ, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইন
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফার সংলাপ শেষে শনিবার (৫ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এ সময় কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম। নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘নির্বাচনি রোডম্যাপের ব্যাপারে যে আলাপটা হচ্ছে, ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। বাকিটা দুই-একদিনের মধ্যে ঘোষণা হবে।’

তিনি বলেন, ‘ছয়টি কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে কথা বলবে, তাদের তিন মাসের টাইমলাইনের মধ্যে। এরপর তিন মাসের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেবে। প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবার উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইন। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়।’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ‘একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনি কাজগুলো এগিয়ে যাবে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজগুলো এগিয়ে যাবে। কারণ যখন ঐকমত্যটা রিফর্মের ব্যাপারে রিচ হলো, যাতে খুব দ্রুত নির্বাচনটা দিয়ে দেওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না। প্রসিডিওরটা কীভাবে হবে তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’ এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর।

কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে