ফ্রি ফায়ার-পাবজি খেলে নৃশংস, তুচ্ছ ঘটনায় ২ সহপাঠীকে হত্যা

প্রকাশিতঃ 12:05 am | March 29, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান ও তার সহযোগীরা মিলে একই স্কুলের দশম শ্রেণির ৩ সহপাঠীকে ছুরিকাঘাত করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারুফ হোসেন বাপ্পী ও নাফিজ মোস্তফা আনছারি মারা যায়।

ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার এড়াতে প্রথমে ঢাকায় পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার একটি চরে গিয়ে আত্মগোপন করে রায়হান। পরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৩ এর একটি দল অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তাররা হলেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি রায়হান কাজী ওরফে রিমন (১৫), হাসিবুল ইসলাম ওরফে হৃদয় (১৫)।

র‌্যাব বলছে, গ্রেপ্তার রায়হান নিয়মিত ফ্রি-ফায়ার এবং পাবজি গেমসে আসক্ত ছিল। এসব গেমসে সে মারামারি দেখে এ ধরনের নৃশংস কাজে উৎসাহিত হয়েছে বলে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান, লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এর আগে গেল ২২ মার্চ পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর দুই শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন বাপ্পী ও নাফিজ মোস্তফা আনছারী একই স্কুলে পড়ুয়া কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীর হাতে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়। এই ঘটনায় ২৪ মার্চ ভুক্তভোগীদের পরিবার বাদী হয়ে বাউফল থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর-২৪) দায়ের করে।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২৭ মার্চ রাতে নরসিংদীর রায়পুরা ও রাজধানীর পল্লবী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি মো. রায়হান কাজী ওরফে রিমন (১৫) ও তার সহযোগী মো. হাসিবুল ইসলাম ওরফে হৃদয়কে (১৫) গ্রেফতার করে র‍্যাব-৩।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ২২ মার্চ স্কুলের ক্লাসের বিরতির সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নবম শ্রেণীর সৈকত ও দশম শ্রেণীর মারুফের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। নবম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী রায়হান এগিয়ে এসে সৈকতের পক্ষ নিয়ে মারুফ ও তার সহপাঠী নাফিজ, সিয়ামসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায়।

একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আশেপাশের আরও কিছু শিক্ষার্থী এগিয়ে এলে সেখানে নবম এবং দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার কারণে তারা নিজ নিজ ক্লাসে চলে যায়। দুপুরে টিফিন বিরতিতে আবার তাদের দেখা হলে মারুফসহ অন্যান্যদের মধ্যে হুমকি দেয় রায়হান।

এর আগে ১৯ মার্চ সকালে মারুফের বন্ধু সিয়াম ও রায়হানের মধ্যে তর্কবিতর্কের ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে পূর্বশত্রুতা থাকায় রেষারেষি ছিল। আগের ঘটনার জের ধরে রায়হান ও তার সহপাঠীদের মধ্যে প্রতিশোধ প্রবণতা এবং উত্তেজনা দেখা দেয়। ফলে সেদিনের অমীমাংসিত বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ঘটনার দিন স্কুল ছুটির পরপর রায়হান তার দলবল নিয়ে মারুফসহ অন্যদের পিছু নিতে থাকে।

রায়হানসহ আরও বেশ কয়েকজন বিদ্যালয় সংলগ্ন পাংগাশিয়া ব্রিজে মারুফ, নাফিজ, সিয়ামসহ অন্যদের গতিরোধ করে। রায়হানের নেতৃত্বে ব্রিজের ওপর আগে থেকে ওত পেতে থাকা সাইদুর ওরফে সৈকত, হাসিব ওরফে হৃদয়, নাঈম হোসেন, সিফাত ও মশিউর মিলে মারুফ, নাফিজসহ অন্যদের মারধর শুরু করে। এরপর রায়হান ছুরি নিয়ে এলোপাতাড়ি সিয়াম, মারুফ ও নাফিজকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে।

রায়হানের ছুরিকাঘাতের ফলে তারা মারাত্মকভাবে আহত হয়। ঘটনাস্থলে তিন শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত অবস্থায় রেখে হত্যাকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে সিয়াম, নাফিজ ও মারুফকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাউফল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মারুফ ও নাফিজকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মারুফ ও নাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঘটনার পর গ্রেফতার আসামি রায়হান ঘটনাস্থল থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে প্রথমে নিজ বাড়িতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি ধুয়ে বাউফলের ধুলিয়া ঘাট থেকে লঞ্চে ঢাকায় পৌঁছে। পথিমধ্যে সে ছুরিটি নদীতে ফেলে দেয়।

এরপর রায়হান কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে নরসিংদীর রায়পুরায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার এক পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হাসিবুল ওরফে হৃদয় হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে পটুয়াখালী থেকে বাসে ঢাকায় পৌঁছে পল্লবীতে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়।

গ্রেফতার রায়হান ওরফে রিমন এবং গ্রেফতার হাসিবুল ওরফে হৃদয় স্থানীয় স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। তারা তাদের সমমনা কিছু উচ্ছৃঙ্খল সহপাঠীদের নিয়ে পাংগাশিয়া এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য সবসময় নিজের সঙ্গে ছুরি ও চাকু বহন করত এবং মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক বিভিন্ন ঘটনায় লিপ্ত থাকত। তাদের উচ্ছৃঙ্খল এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য স্থানীয় স্কুল শিক্ষকসহ অভিভাবকরা তাদের অপছন্দ করতেন।

তারা এলাকায় তাদের সমবয়সী কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করত এবং নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য উৎসাহ দিত। এ ছাড়া গ্রেফতার হাসিবুল এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মারামারিরসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে গ্রেফতার রায়হানের যাবতীয় অপকর্মের অন্যতম সহযোগী হিসেবে থাকত।

গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা।

কালের আলো/ডিএস/এমএম