বৈঠকে ইসরায়েল-হামাস, বিস্ফোরণে কাঁপছে গাজা দ্রুত চুক্তি কার্যকর করার আহ্বান ট্রাম্পের
প্রকাশিতঃ 12:48 pm | October 07, 2025

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, কালের আলো:
গাজায় শান্তি ফেরাতে মিসরের রাজধানী কায়রোয় মিলিত হয়েছেন ইসরায়েল-হামাসের প্রতিনিধিরাসহ মধ্যস্থতাকারীরা। গতকাল সোমবার দুই পক্ষের মধ্যে ট্রাম্পের ২০ দফা নিয়ে পরোক্ষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধ অমান্য করে হামলা অব্যাহত রেখেছে দখলদার বাহিনী। আজ ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২৩ সালের এই দিনে হামাস ইসরায়েলে হামলার পর গাজায় ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। হামলার বার্ষিকীর মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপে আছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গাজা পরিকল্পনা নিয়ে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, পুতিন স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
দুই বছর আগে যে হামলা শুরু হয়েছিল, তা আর থামেনি। গাজার ভবন, বাড়িঘর, পথঘাট মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ৪৮ ঘণ্টায় ১৩১ বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এতে ৯৪ জনের প্রাণ যায়। গতকাল সোমবারের হামলায় একজন ত্রাণপ্রত্যাশীসহ ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত দুই বছরে হামলায় কমপক্ষে ৬৭ হাজার ১৬০ জন নিহত এবং এক লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জন আহত হয়েছেন। গত ৩ অক্টোবর হামলা বন্ধে ট্রাম্পের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১০৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
এদিকে অস্থায়ী তাঁবুতে ফিলিস্তিনিরা তাকিয়ে আছে কবে যুদ্ধ থামবে। বাস্তুচ্যুতরা একটু শান্তির আশায় চেয়ে আছেন বিশ্বনেতাদের দিকে। কারণ তারা যে পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছেন তা অবর্ণনীয়।
দক্ষিণ গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি নাদা। তাঁর স্বামী খাবার খুঁজতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। তিনি এখন দুই ছেলের সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের তাঁবুতে থাকেন। নাদা বলছেন, ঘরবাড়ি ছেড়ে পথেঘাটে রাত কাটানো, এটা কোনো জীবন নয়। তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তির আশায় আছেন।
নাদা বলেন, ‘আমরা জানি না কোথায় যাব বা কী করব। আমি আমার সন্তানদের সঙ্গে একা আছি। পরিবার আমার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের কাছে খাদ্য, পানি ও কাপড় নেই। আমরা প্রার্থনা করছি, একটি চুক্তিতে পৌঁছানো হোক এবং আমরা উত্তরে ফিরে যাব। যদিও সেখানে আমার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
আরেকজন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি নারী আতাফ বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম দিকে তাঁর বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি যতক্ষণ সম্ভব আমার বাড়ি ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলার আঘাত আমাদের টিকতে দেয়নি। আমি প্রার্থনা করি সবকিছুর অবসান হোক এবং আবার যাতে পাড়ায় ফিরে যেতে পারি। বর্তমান অবস্থা কোনো জীবন নয়।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, তারা গতকালও গাজা সিটিতে হামলা চালিয়েছে। তাদের প্রকাশিত ফুটেজে দেখা গেছে, গাজায় একটি বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এক্স পোস্টে এক বিবৃতিতে দখলদার বাহিনী জানায়, তারা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। বাহিনীর ওপর একটি মর্টার বোমাও ছোড়া হয়েছে, ফলে একজন সৈন্য আহত হয়েছে। গত মাস থেকে গাজার বৃহত্তম শহরটি দখলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আক্রমণ তীব্র করে।
গাজা শহরে রোববার রাতভর বোমা হামলা চলে। গতকাল ভোরেও হামলা অব্যাহত ছিল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ভোরে শহরের বেশ কিছু অংশে ইসরায়েলি কামান ও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পাঞ্চল এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোলাবর্ষণ করা হয়। তেল আল-হাওয়ায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হয়। আল-তুফাহ ও জননিরাপত্তা প্রাঙ্গণে বিমান হামলা হয়। গতকাল ভোরে যুদ্ধবিমান তেল আল-হাওয়া, বিচ ক্যাম্প এবং আল-জালায় আঘাত হানে। অন্যদিকে হামিদ রাউন্ডঅবাউট ও আল-শিফা হাসপাতালের কাছে আল-নাসর স্ট্রিট লক্ষ্য করে কামান হামলা চালানো হয়।
এদিকে সবুজ সংকেত পেলে গাজায় মানবিক সাহায্য বৃদ্ধি করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত আছি। খাদ্য ও সরঞ্জাম প্রস্তুত রয়েছে। সবুজ সংকেত পাওয়ার সঙ্গেই গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। জর্ডান, ইসরায়েলি বন্দর আশদোদ এবং অন্যান্য স্থানে হাজার হাজার টন পণ্য প্রবেশের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে এক হাজার ১৫২ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়েছেন।
প্রথম ধাপে বন্দিবিনিময় নিয়ে আলোচনা
মিসরের লোহিত সাগরের তীরবর্তী শারম আল-শেখে যুদ্ধবিরতির আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ধাপে ইসরায়েলে শত শত ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে হামাসের হাতে আটকে থাকা সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে। ট্রাম্প ঘোষিত ২০ দফা পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা। তবে পরিকল্পনাটি ঘিরে অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। পরিকল্পনায় রয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্র ও গাজার ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা।
শনিবার একজন জ্যেষ্ঠ মিসরীয় কর্মকর্তা জানান, মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ মার্কিন আলোচনাকারী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্থানীয় মিসরীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্পের দূত উইটকফ এবং জামাতা জ্যারেড কুশনার মিসরে পৌঁছেছেন। হামাসের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের প্রধান আলোচক খলিল আল-হাইয়া। ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নেতানিয়াহুর আস্থাভাজন রন ডার্মার।
আলোচনা কতক্ষণ স্থায়ী হবে, তা স্পষ্ট নয়। নেতানিয়াহু বলেছেন, সর্বোচ্চ কয়েক দিনের মধ্যেই প্রথম ধাপের আলোচনা শেষ হবে। ট্রাম্প বলেছেন, হামাসকে গাজা থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে। হামাস কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া জিম্মিদের মৃতদেহ খুঁজে পেতে আরও সময় লাগতে পারে। হামাসের হাতে এখনও ৪৮ জিম্মি রয়েছে। ইসরায়েল বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত আছেন। বিন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে এক হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে ইসরায়েলের।
হামাস গত শুক্রবার এক বিৃবতির মাধ্যমে ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নেয়। তবে গাজার নিরাপত্তা প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা চায় তারা। তাদের মতে, ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও রোববার এনবিসি নিউজের মিট দ্য প্রেসে জানান, চুক্তি কার্যকরে বেশি দিন সময় নেওয়া যাবে না। আমরা এটি খুব দ্রুত ঘটতে দেখতে চাই। একই দিন ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি কার্যকর করতে হবে।
গাজা শান্তি পরিকল্পনায় সমর্থন ইরানের
ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনায় আপাতত সমর্থন দিয়েছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, গাজায় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে– এমন যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করে তেহরান। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, পরিকল্পনাটির বিপজ্জনক মাত্রা রয়েছে। পরিকল্পনার বিষয়ে যে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্ভর করে বলে তিনি মনে করেন।
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজার ওপর ইসরায়েলের যুদ্ধের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি তথ্যপত্র প্রকাশ করেছে। এতে ইসরায়েল আরোপিত ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা এবং মানবিক সংকটের বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় গাজাজুড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। ইউএনআরডব্লিউএর ৩৭০ জনেরও বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন। ৯৮ শতাংশেরও বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় ৯০ শতাংশ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। পাঁচ লাখ নারীর মাসিক স্বাস্থ্যবিধি উপকরণের অভাব রয়েছে। ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে সাবানের ব্যবহার নেই। ছয় লাখ ৬০ হাজার শিশু টানা তিন বছর ধরে স্কুলের বাইরে রয়েছে। ৯২ শতাংশ স্কুল ভবনের পুনর্গঠন প্রয়োজন। জাতিসংঘ পরিচালিত ৯০ শতাংশ স্কুল ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুতিন ও নেতানিয়াহু ফোনালাপ
ক্রেমলিন জানিয়েছে, গতকাল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও নেতানিয়াহু ফোনে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধের অবসানের প্রস্তাব নিয়েও কথা বলেন।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, পুতিন আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি সমস্যার একটি ব্যাপক সমাধানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছেন। দুই নেতা আলোচনার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক সমস্যার সমাধান পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
তারা সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা প্রচেষ্টা নিয়েও আলোচনা করেছেন। পুতিন গাজার জন্য ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করে এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার আশা প্রকাশ করেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি মস্কোর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
কালের আলো/এসএকে