হত্যা-অস্ত্র লুটের সাজা এড়াতে তিন দশক আত্মগোপনে ছিলেন চরমপন্থি মানিক

প্রকাশিতঃ 9:06 pm | September 10, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে (৫৬) গ্রেফতার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। ১৯৮৭ সালে গুরুদাসপুর থানা লুট করে একজন কনস্টেবলকে খুন, অস্ত্র লুট এবং আটক চরমপন্থিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

র‍্যাব জানায়, গ্রেফতার মানিক সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য। সর্বহারাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সব কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তিনি ‘ছাত্তার’ নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করতেন।

শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার হাটের দিন বেলা ১১টার দিকে একদল চরমপন্থি ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। পোটলার মধ্যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র লুকানো ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে এবং কয়েকজন জিডি করার উদ্দেশ্যে থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

‘এসময় থানায় দায়িত্বরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। পরে থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুটি এসএমজি, চারটি এসএলআর, ১৮টি রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থি আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে তারা লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়।’

আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাটোরের গুরুদাসপুর থানায় ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামি গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে গুরুদাসপুর থানা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।

তিনি বলেন, র‌্যাব-৩ এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এলাকা থেকে ছাত্তার নামে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করা অবস্থায় সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মানিক ১৯৮৪ সালে চরমপন্থি নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকা ওরফে সর্বহারা দলে যোগ দেন। চরমপন্থি নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকায় উঠতি বয়সী যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করতেন। এ বৈঠকে তিনি আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলতেন। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা পুলিশ হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করবে বলেও ঘোষণা দিতেন।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জন নাটোর, ধামাইর মাঠে এসে জড়ো হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকা এবং হাট এলাকায় অবস্থান নেয়। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকেই কয়েকজন সার্বক্ষণিক টেলিফোন অফিসের কর্মী এবং গুরুদাসপুর থানার ফোর্সের গতিবিধির ওপর নজরদারি করছিলেন। তাদের সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই সুলতানের নেতৃত্বে পাঁচজন টেলিফোন অফিসে প্রবেশ করে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয়। অন্যদিকে, তারেকের নেতৃত্বে গ্রেফতার মানিকসহ প্রথমে চারজন জিডি করার জন্য থানায় প্রবেশ করে এবং মজিদের নেতৃত্বে ১০ জন থানা ব্যারাকে প্রবেশ করে সব ফোর্সকে কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রাখে।

তিনি আরও বলেন, এসময় দায়িত্বরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে তারেক গুলি করে হত্যা করে। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে থানার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারেক অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে সব অস্ত্র, গোলাবারুদ লুটপাট করে এবং থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থি দলের সদস্য ইয়াকুবকে মুক্ত করে। এরপর তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থানা কম্পাউন্ড এবং টেলিফোন অফিস ত্যাগ করে লুণ্ঠন করা অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। তাছাড়া পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলের সদস্যরা ভিড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে প্রতিহত করার পূর্বপ্রস্তুতি তাদের ছিল। লুণ্ঠন করা অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ এবং ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর, চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখে।

আরিফ বলেন, ঘটনার শেষে গ্রেফতার মানিক তার বাড়িতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থি এবং সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নকশালপন্থির ১২ জন নিহত হন।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এ ঘটনার পর মানিকসহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যায়। সকাল হলে পুলিশ ১২টি মরদেহ উদ্ধার করে থানায় মামলা করে। মামলায় মানিক গ্রেফতার হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে। মামলাগুলোতে জামিনে মুক্ত হয়ে মানিকের পলাতক জীবন শুরু হয়। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি আদালতে কোনো হাজিরা দেননি। থানা লুট ও ১২ জনকে হত্যা মামলাসহ মানিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

গ্রেফতার আসামি মানিক ত্রাস সৃষ্টি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। বর্তমানে মানিক নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ এলাকায় ছাত্তার নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৮ সালে মানিক তার নাম পরিবর্তন করে সাইফুল প্রধান নামে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ এলাকায় ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। রূপগঞ্জ এলাকায় তিনি ছাত্তার নামে পরিচিত। রূপগঞ্জ এলাকার মানুষ তার অপরাধ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতো না।

১২ জন হত্যা মামলার পর তারেকসহ চরমপন্থি দলের সদস্যরা চাটমোহর থেকে আত্মগোপন করে সিরাজগঞ্জে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তারা তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মানিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চরমপন্থি দলের সঙ্গে আবারও হত্যা, লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করে ত্রাস সৃষ্টি, অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, পারিবারিক বিরোধ মীমাংসা ইত্যাদি কাজে লিপ্ত ছিলেন।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ সময় গ্রেফতার মানিক তারেকের সঙ্গে নৌকায় বিলের মধ্যে অবস্থান করতেন। দলের কার্যক্রম শেষে তারা আবারও সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় নৌকার মধ্যেই জীবনযাপন করতেন। ২০০৪ সালে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে তারেকের নির্দেশে চরমপন্থিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন মানিক রাজধানীতে চলে আসে। রাজধানীতে কিছুদিন বাসের হেলপারি করে। ট্রাকে মালামাল লোড-আনলোডের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়। ওই আত্মীয় তাকে একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি দেয় এবং সবার কাছে তাকে ছাত্তার নামে পরিচয় করিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান স্তিমিত হলে তারা আবার মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে সর্বহারা দলের কার্যক্রম চালাতে থাকে। ৭-৮ বছর আগে চরমপন্থি দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে তারেক নিহত হলে মানিক সর্বহারা দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়।

রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হিসেবে নিজেকে ছাত্তার নামে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। বর্তমানে এ ঘটনায় জড়িত চরমপন্থি দলের সদস্যদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তারেকের মৃত্যুর পর এ গ্রুপের সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সদস্যদের শনাক্ত করে গ্রেফতারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

কালের আলো/ডিএস/এমএম

Print Friendly, PDF & Email