বদলি আতঙ্কে কাজে মন দিতে পারছেন না এনবিআর কর্মকর্তারা
প্রকাশিতঃ 5:50 pm | July 17, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
বরখাস্ত, অব্যাহতি ও বদলি আতঙ্কে কাজে মন দিতে পারছেন না এনবিআরের কর্মকর্তারা। কিন্তু সংস্কারের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মীদের এখন বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ানো জরুরি। এতে রাজস্ব আদায়ে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন তাঁরা। এমনটাই মনে করেছেন বিশ্লেষকরা।
এনবিআর বিলুপ্তি ও চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবির আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একের পর এক বরখাস্ত হচ্ছেন কর্মকর্তারা। কেউ কেউ পেয়েছন অব্যাহতি। বদলি আতঙ্কও এনবিআরের অধীনস্থ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার আদেশে বলা হচ্ছে, বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলায় তাদের এই শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে সবাই বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এদিকে যাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাদের কমবেশি সবাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
জানা যায়, এখন পর্যন্ত এনবিআরের ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে চারজনকে। ১৬ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। আর অন্দোলেনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বদলি করা হয়েছে অন্তত ১০০ জনকে। এরমধ্যে গেল ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া, মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়ছে ১৪জনকে। আর বুধবার বরখাস্ত হয়েছেন নয়জন।
বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের রুমে গেলে দেখা যায় তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সবার উদ্বেগ, বরখাস্তের তালিকায় নতুন করে কে যুক্ত হলেন! নতুন কোনো খবর আছে কিনা! আর কোনো তালিকা হয়েছে কি না! বিপদ কিংবা শাস্তিতে পড়ার ভয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা সাংবাদিকদেরও এড়িয়ে চলছেন। সহজে মুখ খুলছেন না তারা।
গণক্ষমা চাওয়া শুরু করলেও এখনো এনবিআর কর্মীদের মনোবল রয়েছে তলানিতে। ফলে ভয় নিয়ে কাজে মনোযোগী হতে পারছেন না আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক কর্মীই।
এনবিআর সংস্কারে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সকল সংশোধনী না হওয়া পর্যন্ত জারিকৃত অধ্যাদেশটি কার্যকর করা হবে না। তারই ধারাবাহিকতায় সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে রাজস্ব বোর্ড। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি রাজস্ব বিভাগকে আরও চাঙ্গা করতে কর্মীদের মনোবল বাড়ানো জরুরি।
এনবিআর কর্মীদের উদ্দেশে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘কাজ করে জনগণকে আশ্বস্ত করুন যে, জনগণের জন্য আপনাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। আপনাদের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মীরা কতটা শৃঙ্খলায় ফিরেছে তা তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। পাশাপাশি সংস্কার কাজে এনবিআর কর্মীদের মতামতকেও প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান বিশ্লেষকদের। কর বিশ্লেষক স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, ‘যাদের নিয়ে সংস্কার হবে তাদের কথা বলার সুযোগ না দিলে তাদের বক্তব্য প্রতিফলিত হবে না। সমন্বয় যেন তৈরি হয়।’ দেশের স্বার্থে এবং কাঙ্খিত রাজস্ব আদায়ে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বানও বিশ্লেষকদের।
গত মে মাসে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। রাতের আঁধারে জারি করা সেই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচিতে নামেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এর ব্যানের এসব আন্দোলন হয়। এক পর্যায়ে সরকার পিছু হটে।
গেল ২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাদেশে ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’ আনা হবে। আর সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান কাঠামোতেই চলবে এনবিআরের সব কাজ। এর মধ্যে সংস্থাটির কর্মীরা নানা অভিযোগ তুলে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে নামেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। দাবি আদায়ে ২৮ জুন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেন এনবিআরকর্মীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রফতানিসহ এনবিআরের কার্যক্রম। পরের দিনও কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে সংস্থাটির সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সংকট নিরসনে সেদিন এনবিআর কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফেরার এবং ‘আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কার্যক্রম’ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। পরে সংকট সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটি গঠন করার কথা জানায় সরকার। ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেয়। এর মধ্যে আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের ‘দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানে’ নামে দুদক। তিন দফায় ১৬ জনের তথ্যানুসন্ধান শুরুর তথ্য দেয় সংস্থাটি। আন্দোলন থামার পর এখন একের পর এক কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এনবিআর।
কালের আলো/এমএএইচএন