করোনা প্রতিরোধ, ম্যাজিক বুলেট ও সম্ভাবনার গল্প

প্রকাশিতঃ 11:16 am | April 30, 2021

ডা. মারুফুর রহমান অপু :

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছর এই সময়ে কোনও বাড়িতে করোনা রোগী আছে জানলে মানুষ ওই বাড়ির ধারে কাছে যেতে ভয় পেতো। এলাকাবাসী করোনায় মৃত রোগীর কবর দেওয়া নিয়ে ঝামেলা করতো, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাসা ভাড়া দিতো না বা বাসা ছেড়ে দিতে বলতো বাড়িওয়ালারা। এখন দিনে ১০০ করে লোক মারা যাচ্ছে, তাও মানুষ করোনাকে আগের মতো ভয় পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের এই ব্যবহারে হতাশ হয়ে দেশ ও জাতিকে গালাগাল করে কোনও লাভ নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই মহামারি চলার কারণে মানুষ এর ভয়াবহতাকে সয়ে নিয়েছে, যেমনটা কলেরার ক্ষেত্রে হয়েছে। কলেরা একসময় মারাত্মক রোগ ছিল, এখনও আছে। কার্টুন চরিত্র মীনা বহু বছর চেষ্টা করে দেশে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার বাড়াতে পারলেও খাওয়ার আগে ও পরে ভালো করে হাত ধোয়ার অভ্যাসটা বাংলাদেশে এখনও ততটা বেশি না। তবে কলেরায় ওরস্যালাইনের মতো যুগান্তকারী চিকিৎসা চলে আসায় মৃতপ্রায় মানুষকে ম্যাজিকের মতো বাঁচিয়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সিজনাল প্রকোপ সেভাবে না কমলেও ভয়াবহ এই রোগটি আমাদের বশে আছে।

করোনার ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা তা-ই হবে? আমরা যতই বলি, মাস্ক, শারীরিক দূরত্ব, সব সময়েই দেখা যাচ্ছে একটা বড় সংখ্যক মানুষ এটা মানছে না এবং মানবেও না যদি খুব শক্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা না হয় দীর্ঘদিন ধরে। সুতরাং করোনা হয়তো ছড়াতেই থাকবেই, মৃত্যুর মিছিলও বাড়বে। প্রতিরোধের সকল চেষ্টা চলছে চলুক, আমরা বরং প্রতিকারের দিকেও একটু তাকাই। বর্তমানে কোভিড-১৯-এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বলতে এখনও কোনও ওষুধ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ডক্সিসাইক্লিন, আইভারমেকটিন ইত্যাদির নিয়ে অনেক গবেষণা চললেও কার্যকারিতার খাতায় নাম লেখাতে পারেনি কেউ। দামি ওষুধ অ্যান্টিভাইরাল রেমডিসিভির, ফ্যাভিপিরাভির ইত্যাদিও হাসপাতালে ভর্তির সময় কয়েকদিন কমানো ব্যতীত বড় কোনও পরিবর্তন দেখায়নি। সাশ্রয়ী ওষুধ ডেক্সামেথাসন সে তুলনায় ভালো ফলাফল দিচ্ছে আর সাইটোকাইন স্টোর্মে পড়া আইসিইউ রোগীর জন্য টসিলিজুমাবও কিছু ক্ষেত্রে সফলতা দেখাচ্ছে। প্লাজমা থেরাপি অনেক আশা জাগালেও এখন পর্যন্ত এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি, অন্যদিকে নানারকম ভিটামিন ও মিনারেলের ককটেল আদৌ কোনও উপকারে আসে কিনা সেটা নিয়েও বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক মহল সন্দিহান। তাহলে কোনও ম্যাজিক বুলেট কি আর আসবে না?

করোনার চিকিৎসায় সম্ভাব্য ম্যাজিক ড্রাগ হতে পারে এমন যুগান্তকারী ওষুধের সন্ধানে গবেষণায় ব্যস্ত আছে বিশ্বের শত শত গবেষক অনেকদিন ধরেই। গত বছর জানতে পারলাম অস্ট্রিয়ার কোম্পানি এপেরিওন বায়োলজিক্স একটি চমৎকার আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে। আইডিয়াটি খুবই সাধারণ। করোনাভাইরাস আমাদের দেহকোষে ঢোকে কোষের গায়ে লেগে থাকা ACE2 নামের একটি রিসেপ্টরের মাধ্যমে। এই রিসেপ্টরের সঙ্গে করোনার স্পাইক প্রোটিন নামের কাটার মতো অংশ আটকে যায়। তারপর ভাইরাসটি কোষের ভেতরে ঢোকে। এখন আমরা যদি প্রচুর পরিমাণে কৃত্রিম ACE2 বানিয়ে শরীরে দিয়ে দেই তাহলে করোনাভাইরাস টোপ গেলার মতো এসব কৃত্রিম ACE2-এর সঙ্গে আটকে যাবে কিন্তু কোন কোষে ঢুকতে পারবে না বা কোষে ঢোকার হার কমে যাবে। ভাসমান ACE2-এর সঙ্গে আটকে যাওয়া করোনাকে সহজে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বের করে দেবে আর কোষের মধ্যে যে অল্প কিছু ঢুকেছিল সেগুলোও খুব বেশি মাত্রার রোগ তৈরি করতে পারবে না। সহজ কিন্তু দারুণ আইডিয়া!

এই কৃত্রিম ACE2 তৈরি করাও খুব একটা কঠিন কাজ না, এমন মানব প্রোটিন আমরা অহরহই তৈরি করি যেমন ইনসুলিন। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই কৃত্রিম ACE2 করোনা আসার আগেই তৈরি করা হয়েছে অন্য কয়েকটি রোগে ফুসফুসের ক্ষত কমানোর জন্য এবং সেগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে এই ড্রাগটি মানবদেহে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ।

রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজির মাধ্যমে তৈরি হিউম্যান ACE2 প্রোটিন তাই একে সংক্ষেপে rhACE2 বলা হয় এবং নির্মাতা কোম্পানির কোড নাম দিয়েছে APN01। সম্প্রতি APN01-এর ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হয়েছে। যদিও পূর্ণাঙ্গ ডাটা এখনও তারা পাবলিশ করেনি, প্রেস রিলিজে বলেছে ট্রিট্মেন্ট গ্রুপে মৃত্যু, ভেন্টিলেশন পিরিয়ড, ভাইরাল লোড, ইনফ্লামেটরি মার্কার সবই কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় পরিসংখ্যানগতভাবে যথেষ্ট কম। ডাটা পাবলিশ হলে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। তবে প্রি ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে ল্যাবে দারুণ ফলাফলের তথ্য সেলপ্রেস জার্নাল এবং একটি কেস রিপোর্ট ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে।

ওষুধটি নিয়ে আমি দারুণভাবে আশাবাদী। সফল হলে জানি না এই ড্রাগটি কত দ্রুত মার্কেটে আসবে বা দাম কেমন হবে বা আমরা পাবো কিনা। তবে এটুকু জানি বাংলাদেশের এ ধরনের ড্রাগ তৈরি করার সক্ষমতা আছে। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর উৎপাদন অংশটুকু যথেষ্ট উন্নত। কিন্তু একটি অরিজিনাল থিওরি থেকে ল্যাবে টেস্ট করে প্রোডাক্ট পর্যায়ে আনার জন্য যে গবেষণা মনন ও পরিবেশ দরকার সেটির অভাব আছে। এই কাজগুলো আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব প্রযুক্তি বিভাগগুলোর করার কথা ছিল, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ল্যাবরেটরি সম্ভব না হলে সম্মিলিত বড় ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটি থাকা সম্ভব ছিল, ব্যাঙ্গালোরের মতো বায়োটেক ভ্যালি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেরাম ইনস্টিটিউটের মতো আমাদেরও এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, করপোরেট জায়ান্টদের গবেষণায় ইনভেস্ট করা সম্ভব ছিল…বিসিএস, মাস শেষে নিশ্চিত বেতন, ভার্সিটি আর নম্বরভিত্তিক মেধার মূল্যায়ন আর চর্বিত চর্বনের ‘থিসিস’-এর মোটা বই বানানোর কালচার থেকে যদি বের হয়ে আসতে পারতাম শুধু।

ভারতের ব্যাংগালুরু বায়োটেক ক্যাপিটাল হিসেবে গড়ে উঠেছে আরও অনেক আগেই। ভারতের সিলিকন ভ্যালি বা আইটি ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যাঙ্গালুরু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই সিলিকন ভ্যালির পাশাপাশিই গড়ে উঠেছে বায়োটেক ভ্যালি। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউসি বার্কলের মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন করপোরেট জায়ান্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জন্ম দিয়ে প্রচুর বায়োটেক স্টার্টাপের। ধারণা করা হচ্ছে, সারা বিশ্বের বায়োলজিক্স ও বায়োটেক প্রডাক্টের চাহিদা হয়তো এই অঞ্চল থেকেই মিটবে। ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সেটি প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে আমাদের রফতানির মূল অংশটি বহু বছর ধরেই রেডিমেড গার্মেন্ট কেন্দ্রিক, ইপিজেডগুলো এই ব্যবসাকে ঘিরেই। সময় হয়েছে আমাদের অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার। নতুন দিনের পণ্য এখন বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রির হাতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মতো শিক্ষকদের গবেষণা প্র্যাকটিস ও সেখান থেকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ, আন্ত-প্রাতিষ্ঠানিক স্টেট অফ দ্য আর্ট ল্যাবরেটরি, সরকারিভাবে ডেডিকেটেড বায়োটেক ইউনিটের মাধ্যমে বায়োটেক ইনকিউবেটর, ল্যাব, প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি গড়ে ওঠার মতো বিশেষায়িত জোন ইত্যাদি তৈরি হলে আমরাও শামিল হতে পারি এই প্রতিযোগিতায়। নিজের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করতে পারি যেভাবে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো জেনেরিক ড্রাগের ক্ষেত্রে করছে। হবে কি কখনও? বায়োটেক স্টার্টাপ, ইনকিউবেটর, প্রসেসিং জোন, বায়োটেক ভ্যালি, নতুন দিনের কারখানা?

লেখক: ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মেডিকেল বায়োটেকনোলজি), এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদফতর।