ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুত

প্রকাশিতঃ 5:39 pm | July 18, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় দ্রুত মজুত ফুরিয়ে আসছে। সরকারের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, এখন খনিটির মজুতের একেবারে শেষ দিকের গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুন অনুসন্ধান কূপগুলোতে গ্যাস না পাওয়া গেলে সামনে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। গত ৩০ জুন পেট্রোবাংলা দেশের খনিগুলো থেকে মোট ১ হাজার ৮৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা একাই সরবরাহ করেছে ৯২৭ মিলিয়ন ঘনফুট, যা মোট সরবরাহের ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ খনিটি এখনও দেশের গ্যাস সরবরাহের প্রধান ভরসা। হঠাৎ করে এর উৎপাদন কমে এলে সারা দেশে গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে।

শুধু বিবিয়ানায় নয় অন্য দেশীয় কূপগুলোতেও সঞ্চিত গ্যাসের মজুতের একই অবস্থা। ফলে জ্বালানির এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানি নিরাপত্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, একটি কৌশলগত ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। সময়মতো উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে এর ফল হতে পারে ভয়াবহ। তাই এখনই জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন—না হলে  চলমান সংকটকে ভবিষ্যতের বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে৷

জানা যায়, বর্তমানে বিবিয়ানার ২৬টি কূপের মধ্যে ১১টি থেকে নিয়মিত গ্যাস তোলা হচ্ছে। কিছু কূপে গ্যাসচাপ কমে আসায় সেখানে কম্প্রেসার বসিয়ে উত্তোলন চলছে। বছর পাঁচেক আগেও এই খনি থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হতো। এখন তা কমে ৯২৭ মিলিয়ন ঘনফুটে এসে ঠেকেছে।

বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মজুত ছিল বিবি ৬০ এবি কূপে—মোট ৩ হাজার ৩৬৪ দশমিক বিলিয়ন ঘনফুট। আর ৬-বিসিএফ, যার মধ্যে ৮৭ শতাংশ (২ হাজার ৯২৭ দশমিক ৯ বিসিএফ) উত্তোলন হয়ে গেছে। প্রায় একই হারে উত্তোলন হয়েছে বিবি ৬৫ কূপ থেকেও—৮৭ শতাংশ। বিবি ৭০ কূপে উত্তোলনের হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮৯ শতাংশ ।

অন্যদিকে, বিএইচ ১০, বিএইচ ২০ এবি, ২০ সি ও ২০ ডি কূপগুলোর মজুতের প্রায় ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে, অর্থাৎ এই কূপগুলোতে তুলনামূলক কিছুটা বেশি গ্যাস অবশিষ্ট রয়েছে—৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। বাকি কূপগুলোর মধ্যে, বিএইচ ২৫-এ ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ, বিএইচ ৫০ এ-এ ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ, বিএইচ ৫০ বি-তে ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বিএইচ ৬০ কূপে ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নির্ভর ও অস্থায়ী মজুত দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে। হঠাৎ আমদানি ব্যাহত হলে কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো দেশে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানিতে ব্যাপক সমস্যায় পড়বে, যার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পখাতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভূতত্ত্ববিদেরা দেশেীয় গ্যাসকূপ থেকে উত্তোলনের তাগিদ দিলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তাতে গুরুত্ব দেয়নি। উল্টো উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিতে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে।

তারা বলছেন, দেশে কৌশলগত মজুদ গড়ে তোলা, নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে গতি আনা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১০০টি নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নিলেও প্রকল্পের দৃশ্যমান কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া গভীর সমুদ্র থেকেও গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে ডলারের দরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দেশে বৈদেশিক মূ্দ্রার রিজার্ভ ঘাটতি থাকায় সবসময় প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও নানা সংকটের মধ্যেও জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে বিশেষভাবে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

কালের আলো/এমএএইচএন