লকডাউনেই হোক করোনা ডাউন!

প্রকাশিতঃ 10:45 am | April 05, 2021

প্রভাষ আমিন :

গত এক বছর ধরেই ‘লকডাউন’ শব্দটি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশেও শব্দটি পরিচিত, তবে সে অর্থে এর অভিজ্ঞতা নেই বাংলাদেশের মানুষের। গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরুর পর বাংলাদেশ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি কাটিয়েছে। রাজাবাজার এবং ওয়ারি এলাকায় আঞ্চলিক লকডাউন হলেও দেশজুড়ে লকডাউন এই প্রথম। তাই লকডাউন হলে কী হবে, কীভাবে তা কার্যকর হবে, সাধারণ ছুটির সাথে লকডাউনের পার্থক্য কী; তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, কার্যকর লকডাউন ছাড়া তা নিয়ন্ত্রণে আর কোনো উপায় নেই। লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে আমার নিজেরই কিছু সংশয় আছে। কারণ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়।

দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে সরকার ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি দিলেও আমরা তখন সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলেছি। এবার এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। লকডাউন মানে যেন লকডাউনই হয়। আমরা যেন লকডাউন দিয়ে করোনাকেও ডাউন করতে পারি। আগের মতো চোর-পুলিশ খেলে অযথা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলার কোনো মানেই হয় না। এবার লকডাউনে সরকার অনেক সুনির্দিষ্ট এবং লকডাউনে জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ের চেষ্টা আছে। জীবিকা টিকিয়ে রেখে অর্থনীতিকে সচল রেখেই লকডাউন কার্যকর করার কথা বলা হচ্ছে।

এই লকডাউন কার্যকর হবে কিনা, করোনার সংক্রমণের ঢেউ নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা; সেটা নির্ভর করবে আপনার ওপর; ঠিক পড়েছেন- আপনারই ওপর। লকডাউনকে শাস্তি মনে করবেন না, সরকারকে প্রতিপক্ষ মনে করবেন না। করোনার এবারের ভয়াবহতা কিন্তু গতবারের চেয়ে অনেক বেশি। এবার করোনা হুট করেই মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাসপাতালের আইসিইউ থেকে আপনার বাসা অনেক নিরাপদ। বাসায় থাকুন। পরিবারকে সময় দিন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করুন।

আগের বার সাধারণ ছুটির সময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে সরকার এবং বিজিএমইএ নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে। একবার তাদের এনেছে, একবার বাড়ি পাঠিয়েছে। এবার সরকার আগ থেকেই সবকিছু সুনির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। এবার লকডাউনেও গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা খোলা থাকবে; ব্যাংক-শেয়ারবাজারও চালু থাকবে। পাশাপাশি যথারীতি খোলা থাকবে জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজর।

অতি জরুরি কাজ ছাড়া কেউ যাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেউই বাসা থেকে বেরুতে পারবেন না। তবে বইমেলা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত পুরো লকডাউনকেই হাস্যকর করে তুলতে পারে। মানুষ ঘর থেকে বেরুতে না পারলে বইমেলায় যাবে কীভাবে? সরকার যদি সত্যি সত্যি সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রেখেও কঠোর লকডাউন কার্যকর করে, তাতে সুফল মিলতে পারে।

এ সুফলটা কিন্তু আমাদের জন্যই, আমাদের প্রত্যেকের সুস্থতার জন্য। নিজের ভালো নাকি পাগলেও বুঝে, কিন্তু আমার মনে হয় পাগলের চেয়েও অবুঝ, নিজের ভালোটা বুঝি না। সাধারণ ছুটির সময় দেখেছি অনেকে পুরোনো প্রেসক্রিপশন পকেটে নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন। পুলিশ ধরলে বলতেন ওষুধ কিনতে যাচ্ছি। গাড়িতে ‘কিডনি রোগী’ লিখে কাঁচাবাজার করতে গেছেন, এমনটা দেখেছি নিজেই। আমরা যদি সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলোও মেনে চলতাম, তাহলেও হয়তো লকডাউনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

গত ২৮ মার্চ সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই নির্দেশনার কিছুই আমরা মানিনি। বিশেষ করে গত শুক্রবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রের চিত্র আর বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ সমাবেশ দেখার পর আমার মনে হয়েছে আমরা আসলে লাঠির মানুষ, নরম কথায় আমাদের কাজ হবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণের একদম প্রাথমিক ও কার্যকর অস্ত্র হলো মাস্ক ব্যবহার। কিন্তু গ্রামের মানুষ তো বটেই শহরের অনেকেও মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে উদাসীন। কেউ পকেটে রাখেন, কেউ থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখেন। একটা ছোট্ট মাস্ক দিয়ে যে করোনাকে ঠেকানো সম্ভব ছিল, এখন লকডাউনেও তা কঠিন হয়ে গেছে। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে, এটা আমরা সবাই জানি। সেনানিবাসে সেটা আমরা সবাই মানি। কিন্তু বাইরে বেরুলেই সবাই বনে যাই রাস্তার রাজা। তাই কার্যকর ফল পেতে লকডাউন কার্যকর করতে হবে সেনানিবাস স্টাইলে।

লকডাউনের সময় আমরা যেন নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষদের ভুলে না যাই। সাধারণ ছুটির মতো এবারও সরকার, সরকারি দল, সামাজিক সংগঠন যেন সাধারণ মানুষের পাশে থাকে; সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যেন আমাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর পাশে থাকি। ড্রাইভার, সহকারী, গৃহকর্মীরা যেন কোনো বিপদে না পড়েন। আমরা সবাই যদি চারপাশে একটু মানবিক দৃষ্টি নিয়ে তাকাই, তাহলে সরকারের দায়িত্ব অনেক কমে যাবে।

প্রিয় পাঠক, এই লকডাউন কার্যকর হবে কিনা, করোনার সংক্রমণের ঢেউ নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা; সেটা নির্ভর করবে আপনার ওপর; ঠিক পড়েছেন- আপনারই ওপর। লকডাউনকে শাস্তি মনে করবেন না, সরকারকে প্রতিপক্ষ মনে করবেন না। করোনার এবারের ভয়াবহতা কিন্তু গতবারের চেয়ে অনেক বেশি। এবার করোনা হুট করেই মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাসপাতালের আইসিইউ থেকে আপনার বাসা অনেক নিরাপদ। বাসায় থাকুন। পরিবারকে সময় দিন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করুন।

ভুলেও বাসা থেকে বেরুবেন না। বাসা থেকে বেরুনো মানে কিন্তু আইসিউইর দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো, ঢাকায় এখন একটি আইসিইউর সিট পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া কিন্তু সমান কথা। তাই নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হলো ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। নিজেদের খামখেয়ালিতে আমরাই এই লকডাউনকে ডেকে এনেছি। এখন যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি, যদি আবারও সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলি; লকডাউন কিন্তু প্রলম্বিত হতে পারে, যা আমাদের জীবন ও জীবিকা দুটিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

৪ এপ্রিল, ২০২১

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

Print Friendly, PDF & Email