আলজাজিরাকে ‘তৈলমর্দন’ না কী সরকারকে প্রেসারে রাখার ‘ফর্মুলা’?

প্রকাশিতঃ 9:48 pm | February 19, 2021

মাহবুবুল আলম, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, কালের আলো:

কাতারভিত্তিক সমালোচিত সংবাদ চ্যানেল আলজাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ শিরোনামে মিলিয়ন ডলার খরচায় প্রচারিত তথ্যচিত্র নিয়ে নতুন করে ‘জলঘোলা’ করার অপপ্রয়াস শুরু হয়েছে পুরোদমে। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনা সদর থেকে দুই দফায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওই প্রতিবেদনটিকে অসত্য, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট কল্পকাহিনীর সন্নিবেশ বলে জানানো হলেও আলজাজিরাকে ‘তৈলমর্দন’ যেন কিছুতেই থামছেই না।

উল্টো জাজিরা ইস্যুকে পুঁজি করে সরকারকে প্রেসারে রাখার ফর্মুলা নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিগণিত একটি দৈনিকের মস্কোপন্থী সৌখিন কম্যুনিস্ট সম্পাদক। ‘প্রেসার গ্রুপ’ এ ফর্মুলাটি অবশ্য তাঁর নিজের সৃষ্টি। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার সরকার গঠনের পর তিনি নিজেই নিজের দৈনিকের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাপ্তাহিক মিটিংয়ে বলেছিলেন- ‘আমরা সরকারকে প্রেসারে রাখতে চাই। আমরা হচ্ছি প্রেসার গ্রুপ।’

নিজেদের রম্য ম্যাগাজিনে একবার মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে নিয়ে ব্যঙ্গ-কার্টুন প্রকাশ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তোপের মুখে জনসম্মুখে ‘তওবা’ করে নিজেকে ‘শেষ রক্ষা’ করেছিলেন। গত কয়েকদিনে তাদের কান্ডকীর্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আলজাজিরার অসম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ করতেই তারা উঠেপড়ে লেগেছেন।

এক্ষেত্রে তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও ঘৃণ্য কায়দায় ঘায়েল করতেই নিজেদের নিশানা তাক করেছেন। মূলত এক এগারোর ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র মতোই নতুন মতলব নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছেন কীনা এ বিষয়টিও এখন বড় এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিমাংসিত একটি বিষয়কে ‘দুধে আলতা’ বানিয়ে নতুন করে রাঙানোর মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিজেদের অসচ্ছতা, অনিয়ম ও স্বার্থান্বেষী মনোভাবকেই দিবালোকের মতোই স্পষ্ট করে তুলেছেন।

আমরা দেখেছি আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সেনাপ্রধানের দুই ভাই আনিস ও হারিস দু’জনেই মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল ও পলাতক। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো তারা মোটেও মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল নন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার তাদেরকে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সরকারের আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কয়েক দফা বক্তব্যের মাধ্যমে ‘ধোঁয়াশা’ কাটিয়েছেন। কিন্তু আলজাজিরার আষাঢ়ে গল্প নির্ভর এমন অপপ্রচারের সূত্র ধরেই আমাদের দেশেরও একটি দৈনিক একই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।  

আইন মেনে তারা হারিস এবং আনিসের সাজা মওকুফকে যেন কোনভাবেই মানতে পারছে না। রীতিমতো গাত্রদাহ শুরু হয়েছে তাদের।  একই ধারা মোতাবেক সাজাপ্রাপ্ত বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা নাজিউর রহমান মঞ্জুরকেও দন্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। দন্ডমুক্ত হওয়ার পরেই নাজিউর দেশে ফিরেছিলেন। এ উদাহরণটি তারা বেমালুম চেপে গেছেন বলেই হয়তো আপনারা মনে করবেন। কিন্তু এই গল্প টানলে তাদের মহৎ কর্মযজ্ঞটিই মোটাদাগে ভেস্তে যাবে, এটা বলতেও কোন দ্বিধা নেই আমার।  

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থগিত করে তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হারিস এবং আনিসের দন্ড থেকে অব্যাহতির মাধ্যমে ‘জাত গেলো, জাত গেলো’ ধুয়োধ্বনির মাধ্যমে মূলত তারা নিজেদের পুরনো চরিত্রেই ফিরেছেন। ভুলে গেলে চলবে না রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদের উচ্ছেদ করে সুশীল সমাজের অংশ বলে পরিচিত এলিট নাগরিকদের (!) রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস নিয়েছিলেন কিন্তু এ চক্রটিই।

আলজাজিরার প্রতিবেদনের যেমন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক একটি উদ্দেশ্য ছিল তেমনি আমাদের দেশীয় চক্রটিরও একই উদ্দেশ্য বেশ পুরনোই বটে! জাজিরার প্রতিবেদনের দুর্বলতা ও অসঙ্গতি নিয়ে দেশের প্রতিটি গণমাধ্যম সক্রিয় ও সোচ্চার অবস্থান গ্রহণ করলেও তারা যেন ‘ঘাঁটিয়া’ অন্ধকারেই বসত করেছেন। আলো ছড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে নিজেদের আত্নপ্রকাশ দাবি করলেও তারা সব সময় অসত্য কথনের মাধ্যমে গ্রীষ্মের বারুদ জ্বালিয়ে এক এগারোর বিতর্কিত ভূমিকাতেই আবির্ভূত হয়েছেন প্রতিবার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় দেশকে রাজনীতি ও রাজনীতিক শূন্য করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন দেশীয় চিহ্নিত এ চক্রটি। কিন্তু তাদের সেই গর্হিত অপকর্মের আজও কোনো বিচার হয়নি। উল্টো আমরা দেখেছি ফ্রিডম পার্টির ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর-মিরপুর শাখার কো-অর্ডিনেটর, ভয়ানক সিরিয়াল কিলার ডাকাত মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাকে তারা নিজেদের প্রতিবেদনে ‘ব্যবসায়ী’ পদকে ভূষিত করেছেন।

কিন্তু তারা বলেননি, এই খুনি ও তাঁর সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন হারিস-আনিস-জোসেফের সহোদর ভাই ছাত্রলীগ নেতা ভিপি সাঈদ আহমেদ টিপু। তারা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলার এজাহারভুক্ত ১৮ নম্বর আসামি ছিলেন এই মোস্তফা। আনিস-জোসেফরা নিজের ভাইয়ের হত্যাকান্ডের বিচার আজও পায়নি। এ নিয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আর থাকবেই বা কী করে, এসব তথ্য উপস্থাপন করলে যে তাদের আসল উদ্দেশ্যেই আর হাসিল হবে না।

আলজাজিরার ফিল্মি প্রতিবেদনের পাসপোর্ট ইস্যুর পর ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত দৈনিকটিও একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। কিন্তু পাসপোর্ট নিয়ে জাজিরার মিথ্যাচার নিয়ে তারা কোন কথা বলেনি। বিভিন্ন দৈনিক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই বলছি, মোহাম্মদ হাসানের পাসপোর্টটি কোনভাবেই জাল নয়।

কারণ, এই মোহাম্মদ হাসানের নামেই তাঁর বার্থ সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয় পত্র সবকিছু। রাজনীতিতে তিনি সহকর্মী-সতীর্থদের কাছে ‘হারিস’ নামে পরিচিত ছিলেন। এক্ষেত্রেও জাজিরার মতোই আলো গ্রুপের ‘ঘাঁটিয়া’ অন্ধকারে বসবাসের একটি নমুনা তুলে ধরছি।

এ প্রসঙ্গে আমি একজন কলামিস্টের একটি লেখাকে উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘মালয়েশিয়ায় ২০০৭ সালের যে প্রোপার্টি দেখানো হলো সেই ডকুমেন্টে (৫.৫৭ মিনিট) মোহাম্মদ হাসান নামে পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ রয়েছে। যার ২০০৭ সালেই পাসপোর্ট থাকে, তার কেন ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় পাসপোর্ট করার প্রয়োজন হবে?’

আলজাজিরার প্রতিবেদনের পর একাধিক টকশোতে দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘এ দেশে রোহিঙ্গারা হাজার হাজার ভূয়া পাসপোর্ট তৈরি করেছেন। বাংলাদেশ তো  বটেই ভারত ও পাকিস্তানেও এ ধরণের পাসপোর্ট হরহামেশাই হয়ে থাকে।’

আমার কথা হচ্ছে, জালিয়াতি বা ভূয়া পাসপোর্টের বিষয়ে ওই দৈনিকটিকে কোন সময়ই সোচ্চার হতে দেখা না গেলেও হারিস-জোসেফদের পাসপোর্টকে ‘দুই নম্বর’ হিসেবে প্রমাণ করতে তাদের দাপাদাপি-লাফালাফি অতীতের মতোই তাদের নানা ঘৃণ্য ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হীন মনমানসিকতার বহি:প্রকাশ ঘটাচ্ছে তা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই ঘৃণার উদ্রেক করেছে প্রচন্ডভাবে। ওয়ান ইলেভেনে গণতন্ত্র বিরোধী ভূমিকার কারণে একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শরমিন্দা হয়ে ওই সম্পাদক দু:খ প্রকাশ করে অন্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল এভাবে-‘১/১১’র ঘষেটি বেগমের ভুল স্বীকার’। অতএব, সাধু সাবধান।

কালের আলো/এমএ/জিকে

Print Friendly, PDF & Email