মাদকাসক্তি এক জনস্বাস্থ্য সমস্যা

প্রকাশিতঃ 11:01 am | November 18, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

একজন সফল উদ্যোক্তা, সমাজসেবক মানুষ আমাকে বলছেন তিনি ব্যর্থ পিতা। তার দুই সন্তান, প্রথিতযশা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াকালীন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কোনোভাবেই তিনি ও তার স্ত্রী টের পাননি যে তাদের দুই সন্তান মাদক সংগ্রহ করছে, নিজেরা সেবন করছে এবং বহন করে অন্যদের কাছে পৌঁছেও দিচ্ছে। স্কুলের শিক্ষকরা টের পেয়েও সময়মতো জানাননি। যাই হোক দীর্ঘসময় বিদেশের একটি রিহ্যাব সেন্টারে রেখে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তারা এখন বাবার ব্যবসা দেখছে এবং ভালোও করছে।

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা জানি এবং নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ বলতে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামের সস্তা জনপ্রিয় স্লোগান দেই। মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে বিধান প্রণয়নের জন্য ২০১৮ সালের আইনটি পুরোটাই মাদককে দেখেছে অপরাধের দৃষ্টিকোণ থেকেই। উন্নত পশ্চিমা সমাজে এই সমস্যাকে দেখা হয় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে, অপরাধ হিসেবে নয়।

মাদকসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির এমন অবস্থার কারণেই এর নিয়ন্ত্রণ আলোচনার পুরোটাতেই প্রশাসনিক মনস্তত্ব কাজ করে অভিযান পরিচালনায়। মাদকব্যবসা ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ থেকে পশ্চিমা সমাজ এর ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে বেশি। তারা দেখছে কোন কোন পানীয় বা সামগ্রীকে বৈধতা দিলে অতি নেশা সৃষ্টিকারী ও ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য থেকে মানুষ সরে আসে। তাই মাদক আর আসক্তি- এই দুটি বিষয়কে আলাদা করে ভাববার প্রয়োজন আছে।

মাদক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে মারিজুয়ানা বা গাঁজাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। কেউ সঙ্গে গাঁজা রাখলে বা তা ব্যবহার করলে তাকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা বন্ধ হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টিই আছে কড়া নজরদারি ও একটা সুষ্ঠু সিস্টেমের ভেতর।

আমরা তার পারিনি এবং পারব কিনা জানা নেই। তবে মাদকাসক্তি যে একপ্রকার অসুস্থতাও, তার একটি যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োজন এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে সামগ্রিকভাবে এর জন্য চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন, সেই ভাবনা আসতেই হবে। কেউ মাদকাসক্ত হয়েছে বলেই সে বিপথে গেছে, তার পরিবারের নৈতিক অবস্থান নষ্ট হয়ে গেছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। সমস্যা হলো আমরা সে কাজটিই করি। আমাদের সমাজ মাদকাসক্তি বা মাদক ব্যবহারকে জনস্বাস্থ্য বিষয় হিসেবে না দেখে এক নৈতিক সংকট হিসেবে দেখে আসছে বলে আজ পর্যন্ত কোনো কুলকিনারা করতে পারছি না আমরা।

মাদকাসক্তকে কলঙ্কিত হিসেবে চিহ্নিত করা, তাকে পৃথক করে রাখা হয় বা তাকে ও তার পরিবারকে সামাজিক লজ্জার মুখে ঠেলে দেয়া হয়, কারণ আমাদের আইনের দৃষ্টিতেই বিষয়টাকে অপরাধ হিসেবে এমনভাবে দেখা হয় যা প্রকারান্তরে মাদকাসক্তকে, তার পরিবারকে এক নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির মাঝে ফেলে দেয়। এভাবে নৈতিকতার ধ্বজা তুলে ধরে মাদকাসক্তদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়া আসলে আরেক বড় অপরাধ।

অনেকে বলছেন মাদকনিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, কারণ এর চাহিদা ব্যাপক। চাহিদা থাকলে সরবরাহ হবেই। আবার কেউ বলছেন সরবরাহও চাহিদা সৃষ্টি করে। এই চাহিদা ও জোগান তত্ত্বও আসলে চূড়ান্ত বিচারে বিভ্রান্তিকর, চরম সরলীকরণ। মাদকসামগ্রী হলো বাণিজ্য, আর আসক্তি হলো একটি মানসিক রোগ। সে জন্যই মাদককারবারি আর মাদকাসক্তকে একই কাতারে বিবেচনার অবকাশ নেই। যে মাদকাসক্ত হয়েছে তার চিকিৎসা প্রয়োজন প্রোটোকল অনুযায়ী।

তাই আমাদের আইনে মাদকাসক্তিকে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিবেচনা করে এই আইনের প্রয়োগ কতটা মানবিকভাবে করা হবে সেটা ভাবা দরকার। মাদকের কারবারিকে যেভাবে জ্ঞান করব, একজন মাদকাসক্তকে সেভাবে বিবেচনা করে তাকে শাস্তিদানের ব্যাপারটা যেন মাথায় না আসে। মাদকাসক্তদের জন্য ব্যাপক চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করাই যেন আইনের উদ্দেশ্য হয়। আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের জন্য ওষুধভিত্তিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, রিহ্যাব সেন্টার রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো খুব সামান্য। এগুলোর পরিবেশ, পরিচালনা পদ্ধতি এবং সক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

নেশাসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে হৃদয় দিয়ে না দেখে যুদ্ধ ঘোষণার হুঙ্কার দিতে পছন্দ করি আমরা। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নিজে হাজার হাজার মাদকাসক্তকে হত্যা করেও এর দাপট কমাতে পারেননি। পুরো বিষয়টি তিনি করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সমস্যাটা হয় এখানেই যে, অপরাধ দমনের দৃষ্টিতে দেখলে, যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা বেশি হলে প্রভাবশালী বড় কারবারিরা পার পেয়ে যায়, ছোটখাটো মাদকবিক্রেতারা অপরাধী হিসেবে বেশি করে চিহ্নিত হয়। কিন্তু আমরা হয়তো বুঝতেও পারি না যে এদের মধ্যে বড় একটা অংশ নিজের আসক্তির জন্যই মাদকের বাহক হয়। বড় কারবারিরা সামাজিক প্রতিপত্তি আর অর্থের জোরে নিজেদের বাঁচাতে পারলেও, পারে না এই রোগাক্রান্ত আসক্তরা।

আমাদেরকেই মনোজগৎ থেকে বের হতে হবে। মাদকাসক্তিকে একটি জনস্বাস্থ্যের সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন, শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ করে নয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

Print Friendly, PDF & Email