দুর্যোগের সময় ত্যাগের মহিমা

প্রকাশিতঃ 7:01 am | August 01, 2020

মোহীত উল আলম:

করোনার সময় কোরবানির ঈদ মুসলমানদের একটি বিরাট সংকটে ফেলেছে। কভিড-১৯ জীবাণুটি সামাজিক মেলামেশা থেকে সংক্রমিত হচ্ছে, এটা বেশ ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সে জন্য এ বছর বিশেষ সতর্কতায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোরবানির সামাজিক রূপটা আমাদের দেশে বিরাট একটি গো-উৎসব। ধর্মীয় তাগিদ এবং সামাজিক তাগিদ মিলে কোরবানির ঈদ এমন একটা উৎসব, যেটির দিকে চোখ বন্ধ করে রাখার উপায় নেই। রোজার ঈদ যখন গেল, তখন করোনার ভয়টা বেশ চেপে বসেছিল, ফলে মানুষ মসজিদে জামাত পড়তে যায়নি এবং ঘরে বসেই ঈদের উৎসব উদযাপন করেছে। সে অর্থে রোজার ঈদ কিছুটা ব্যক্তিগত ঈদ। কোরবানির ঈদ তার বিপরীত। এটি একটি সামাজিক গোষ্ঠীগত পরব।

মুসলমানরা ঈদের জামাত আদায় করার পর আল্লাহতায়ালার শোকরের নিমিত্তে গরু-ছাগল-ভেড়া কিংবা দুম্বা কোরবানি দেয়। কিন্তু এবার করোনার দাপটে মনে হচ্ছে পশু কোরবানি শতকরা ৫০ শতাংশ কমে যাবে। গরুর বাজার থেকে চামড়ার বাজার, চামড়ার বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার- সবকিছুতে ব্যাপক লোকসান হবে। তাহলে করোনার সঙ্গে কোরবানির সাংঘর্ষিক মোকাবিলা হচ্ছে।

মনুষ্য জাতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে দক্ষ। সে জন্য এবার গরুর কেনাবেচা শুরু হয়েছে অনলাইনে। আগের বছরগুলোতে অনলাইনে বেচাবিক্রি শুরু হলেও ব্যাপারটা ছিল অনেকটা ঐচ্ছিক। কিন্তু এবার অনলাইনের খামারগুলোতে বেশ বেচাবিক্রি হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। খামারের পর খামার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছে, এমন এমন গরু এবং এমন এমন ছাগল তাদের খামারে স্বাস্থ্যকরভাবে কোরবানির জন্য তৈরি করা হয়েছে। গরুর স্থির এবং ভিডিও ছবি পাঠানোর পাশাপাশি গরুর ওজন ও দাম জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক খামার দাম চুক্তি ও আগাম জামানত নেওয়ার পর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, তাদের খরচে তারা ক্রেতাদের বাসায় পশু পৌঁছে দেবে।

এই অনলাইন শিফটিং মানুষকে হাটে গিয়ে গরু কেনার ঝামেলা থেকে রক্ষা করছে এবং সেইসঙ্গে করোনা সংক্রমণের ভয়ও কমিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের কাছে অনলাইন ব্যবস্থা প্রয়োগ করার মতো সুযোগ নেই, তারা হয়তো পুরোনো রীতিতেই হাটে গিয়ে ভিড় করবে। তাতে আবার করোনার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। রোজার ঈদের সময় অর্ধেক মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে গিয়েছিল প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। তারা সে সময় খুব স্বাস্থ্যবিধি মেনেছিল এমন কথা বলা যাবে না। আবার যে কোনো কারণে বাংলাদেশে এই সাড়ে চার মাসেও করোনা ভীতিকর অবস্থায় পৌঁছেছে বলা যাবে না। তাই মানুষ আরও সাহসী হবে। তাই এবারও হয়তো কয়েক লাখ লোকের শহর থেকে গ্রামে ও গ্রাম থেকে শহরে গমনাগমন হবে। তবে এবার কোরবানির ক্ষেত্রে পশু জবাইয়ের রিচুয়ালটা যেহেতু সমষ্টিগত (হুজুর, কসাই, গরু ধরার লোক, গৃহস্থ নিজে বা তার লোকেরা মিলে) ব্যাপার, তাই কোরবানির পরপর সংক্রমণ বহুমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহতায়ালার নামে পশু কোরবানি দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মভক্ত মানুষটি নিজেকে আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে দিয়ে নিজের আত্মাকে অশুচি থেকে মুক্ত করল। সবাই জানে যে কোরবানির মাংস আল্লাহতায়ালার দরবারে পৌঁছাবে না, কিন্তু কোরবানির দোয়াটা পৌঁছাবে। অর্থাৎ একটি বস্তুগত জিনিসকে অবলম্বন করে আধ্যাত্মিক লক্ষ্য পূরণ করা। কোরবানির ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যে আদি গল্পটা মুসলমানদের জানা আছে, সেখানে কিন্তু একটি পরীক্ষা করার ব্যাপার আছে- বাধ্যতার পরীক্ষা। আল্লাহ্‌তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বিশ্বাসের পরীক্ষা করলেন। তিনি বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আমার নামে উৎসর্গ করো। তিনি অনেক ভেবে দেখে বুঝলেন, তার প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। পিতা হিসেবে যখন পুত্রের গলায় ছুরি বসাতে গেলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.), তখনই ইরশাদ হলো আল্লাহতালার তরফ থেকে এবং পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) চরম ঘোর কেটে গেলে দেখলেন প্রিয় পুত্রের জায়গায় একটি দুম্বা পড়ে আছে। আল্লাহতায়ালার ইরশাদ অনুযায়ী তিনি ওই দুম্বাই জবাই করলেন এবং পুত্র হত্যার দায় থেকে তার নিস্কৃতি হলো। অর্থাৎ হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহতালার প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শনের ক্ষেত্রে চরমতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।

কোরবানির ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে এই চরমতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। লোভ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া, লোভের আপন হিংসা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া, অর্থাৎ মানুষের যাবতীয় নেতিবাচক চরিত্র, যা মানুষকে ভালো মানুষ হতে দেয় না, সেসব থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়াই হচ্ছে মুসলমানের চিত্তের উদ্বোধনের লক্ষ্য।

মানুষের বদলে দুম্বা প্রবর্তনের ফলে ধর্মীয়ভাবে যেমন, তেমনি সামাজিকভাবেও ‘বিকল্প’ পন্থার সৃষ্টি হলো। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালার ওপর বিশ্বাস যদি অটুট থাকে তখন নিহিত আধ্যাত্মিক গুণের তলায় বস্তুগত পরিবর্তন বা বস্তুগত বিকল্পসাধন আর কোনো গুরুতর অর্থ বহন করে না। আল্লাহ্‌তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বিশ্বাসের শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, সেটি তিনি পেয়েছিলেন বিধায় মানুষের বদলে পশুকে বিকল্প হিসেবে কোরবানি দিতে এজাজত দিলেন।

মুসলমানদের কোরবানির সময় আরও একটি পরীক্ষা দিতে হয়। সেটি হলো, যদিও কোরবানির পবিত্র উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পশু কোরবানি দেয়, কিন্তু এখানেও একটা আধ্যাত্মিক রহস্য কাজ করে। কারণ কোরবানির জন্য নিয়তকৃত পশুটি জাগতিক অর্থে হচ্ছে গোশতের সমাহার; অর্থাৎ খাদ্যবস্তু এবং ব্যবসায়িক পণ্য। তা হলে মুসলমানদের ‘দিলে’ আল্লাহতায়ালার প্রতি প্রচণ্ড ভীরুতা না থাকলে সে চোখের সামনে যে পশুটা দেখছে, সেটিকে সে আল্লাহতালার নামে উৎসর্গীকৃত অলৌকিক পশু হিসেবে দেখবে না, দেখবে নিতান্তই গোশতধারী পশু হিসেবে, অর্থাৎ খাদ্যবস্তু হিসেবে। তা হলে যে রহস্যটা এখানে খেলা করছে বললাম, সেটি হলো ‘দিল’ সাফ করার জন্য যে পশুটিকে মুসলমান কোরবানি দিতে যাচ্ছে, সে পশুটিই কিন্তু সে যে লোভটিকে ত্যাগ করতে চাইছে, সে লোভটিই জাগিয়ে দিচ্ছে। কোরবানির পরবের মধ্যে এ দ্ব্যর্থবোধকতা লুকিয়ে আছে বলে ধার্মিক মুসলমানকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়, যাতে কোরবানির জন্য নিয়তকৃত পশুটি তাকে মনের পবিত্রতার বদলে মনের মধ্যে অশুচি পূর্ণ করে না দেয়।

কোরবানির পশুকে তিন ভাগ করে এক ভাগ ফকির-মিশকিন, এক ভাগ গরিব আত্মীয়-স্বজন এবং বাকি এক ভাগ নিজের জন্য রাখার ব্যাপারে ইসলাম উৎসাহিত করে। এটা মানা হয় কিনা আমার জানা নেই।

কোরবানিতে বিপুল গবাদি পশু জবাই করা হয় বলে অনেকে সমালোচনা করেন। কিন্তু বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক খতিয়ে দেখলে এটারও যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কোরবানিতে গবাদি পশুর চাহিদা আছে বলে এদের প্রজনন হয়। মানুষ চাষবাস ও কৃষিকর্মের জন্য, গৃহস্থালি কাজ ও ভক্ষণ এবং বিক্রি করার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে গবাদি পশুর প্রজনন করে আসছে। এটা প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। মানুষ যেমন শাকসবজি খাবে, তেমনি মাংসও খাবে। মানুষ যেগুলো খায় না, সেগুলোর প্রজনন করে না। মানুষ তো বাঘের প্রজনন করে না কিংবা হরিণেরও প্রজনন করে না। কিন্তু গবাদি পশুর প্রজনন করে বিধায় গবাদি পশুর সংখ্যা কখনও কমে না। বাঘ-সিংহ বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই বাংলাদেশও এখন সব রকমের গবাদি পশুতে স্বয়ম্ভর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বাজার অনেক বড়। সেটির একটি বড় উৎস হচ্ছে কোরবানির সময় জবাইকৃত গবাদি পশু।

একটি ভিডিও ক্লিপের কথা বলে আলোচনাটি শেষ করি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া কোনো এক সীমান্তের সজীব ছবি এটি। দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তের অভ্যন্তরভাগ থেকে বাংলাদেশে বিরাট বিরাট গরু পাচার করা হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? দেশীয় তৈরি প্রযুক্তি- একটি বিরাট বাঁশ বড়শির মতো করে বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তর থেকে গরুটিকে দোলনার মতো করে ওপরে তুলে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে উঁচু করে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গরুর পর গরু এভাবে শূন্যে উঠছে আর বাচ্চাদের আনন্দ নিয়ে শূন্য থেকে নামছে। দুই সীমানার সীমান্তরক্ষীদের কোনো দেখা নেই। এটা অবৈধ পথে গরু চোরাচালান হতে পারে, কিন্তু কোরবানির সঙ্গে অর্থনৈতিক সচলতার কথাটাও তো বুঝতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

Print Friendly, PDF & Email