মহামারি : পৃথিবীর সুরক্ষায় পরিবেশ
প্রকাশিতঃ 9:31 am | June 10, 2020

এসএম আরিফ ইফতেখার :
সমগ্র বিশ্বকে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের মঞ্চে একত্র করার প্রয়াসে করোনাভাইরাস মহামারি হতে পারে একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। এই ভাইরাসের বিস্তৃতির উৎস নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। পশুপাখি জাতীয় প্রাণীই সাধারণত ভাইরাস জীবাণু মানবশরীরে ছড়িয়ে দিতে চিহ্নিত উৎস হিসেবে কাজ করে। পশুপাখি থেকে মানবশরীরে ভাইরাস সংক্রমণ বা স্থানান্তরিত হবার এ প্রক্রিয়াকে জুনোটিক ডিজিজ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন), ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিশেষজ্ঞ ড. ক্রিস্টিন জনসন এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, শিকার এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পশুপাখির সাথে মানুষের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস নতুন ধরনের রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অর্থাৎ, সামগ্রিকতার ভিত্তিতে মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাস্থ্যের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, হার্ড ইমিউনিটি, ভাইরাস আক্রান্ত, সুস্থ এবং মৃত্যু এই শব্দগুলোর দৈনন্দিন ব্যবহার মানবমনকে শুধু অস্থিরই করে তোলেনি বরং সৃষ্ট অনিশ্চয়তার দৃশ্যপট আমাদের শারীরিক-মানসিক অবস্থার ওপর মিশ্র প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কিন্তু, এমনটি মনে করার কারণ নেই যে পুরো বিশ্ব প্রথমবারের মতো এ ধরনের মহামারির মোকাবিলা করছে। বরং, ইতিহাস ঘাটলে উল্লেখযোগ্য অনেক মহামারির ঘটনাই আমাদের সামনে চলে আসে। তবে এটা স্বীকার করতেই হয় যে একেকটা মহামারি আমাদের একেক ধরনের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। আর এ অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানবসম্প্রদায় মহামারিকে রোধ করতে বেশ খানিকটা সফলও হয়েছে বলা চলে।
ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য কিছু মহামারির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে এইচআইভি এইডসে প্রায় ৩৬ মিলিয়নের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে; আরও প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে এইডস নিয়ে বেঁচে আছেন এবং তাঁদের অধিকাংশেরই বসবাস আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। রাশিয়ান ফ্লু/এশিয়াটিক ফ্লু (১৮৮৯-১৮৯০), ফ্লু মহামারি (১৯১৮-১৯২০), এশিয়ান ফ্লু (১৯৫৬-১৯৫৮), দ্য হংকং ফ্লুসহ (১৯৬৮) বিভিন্ন ধরনের ফ্লুতে পৃথিবীর প্রায় ৫৫-৬০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন সময়ে প্রাণ হারান। উল্লেখ্য, ফ্লু মহামারিতে (১৯১৮-১৯২০), আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় ৫০০ মিলিয়নের মধ্যে তুলনামূলকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কলেরা কয়েকটি ধাপে ছড়িয়ে পড়লেও ৩য় (১৮৫২-১৮৬০) এবং ৬ষ্ঠ (১৯১০-১৯১১) ধাপে প্রায় এক মিলিয়ন; দ্য ব্ল্যাক ডেথ/ বুবনিক প্লেগে (১৩৪৬-১৩৫৩) প্রায় ২০০ মিলিয়ন; প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান এবং অ্যান্টোনাইন প্লেগে যথাক্রমে প্রায় ২৫ মিলিয়ন ও ৫ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি হয়। দ্য ব্ল্যাক ডেথ/ বুবনিক প্লেগ (১৩৪৬-১৩৫৩) মূলত ইঁদুরের মাধ্যমে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নগর ব্যবস্থায় তৎকালীন সময়ে পোর্টগুলো ব্যবসার মূল কেন্দ্র হওয়ায় ব্যবসায়ীদের জাহাজে করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ইঁদুরগুলো প্লেগ জীবাণুর বিস্তৃতি ঘটায়। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার ও যথাযথ প্রয়োগ ওই সময়ে জাহাজের নাবিকদের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। মহামারির ইতিহাস বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান যে, পশুপাখি জাতীয় প্রাণী দেহ থেকেই অধিকাংশ মহামারির জীবাণুগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়েছে এবং ব্যাপক প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেছে।
মহামারির বিস্তার রোধে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক প্রধান ইঞ্জার অ্যান্ডারসন বলেন, কোভিড-১৯ হচ্ছে একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা এবং এই প্রাণনাশক রোগের জীবাণু পশুপাখি জাতীয় প্রাণী দেহে থাকে; যা মানুষের আচরণগত বিচরণের মধ্যে দিয়ে এটি বৃহৎ আকারে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও উল্লেখ করা হয়েছে, সকল সংক্রামক রোগের প্রায় ৭৫ ভাগ আসে পশুপাখি জাতীয় প্রাণী থেকে। ইঞ্জার অ্যান্ডারসন আরও বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি ও জলবায়ু সংকট আমাদের একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছে, আর এই বার্তা আমাদের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য নয় বরং পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা বলছে। অ্যান্ডারসনের বক্তব্যের বর্ধিত ব্যাখ্যা থেকে বলা যায়, একটি সংক্রামক রোগ বা মহামারির সময়ে প্রতিষেধক বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা নিয়ে আমরা যে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করি তার চেয়ে বরং পূর্ব থেকেই মহামারি সৃষ্টির সম্ভাব্য মূল উৎসগুলোকে যথাসম্ভব চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ক্রমাগত বনাঞ্চল হ্রাস প্রভৃতি বিষয় বৈশ্বিক জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। যা আমাদের তথা পৃথিবীর জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ধীরে ধীরে পরিবেশের ওপর পড়তে থাকে। প্রকৃতিতে থাকা সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুলকে নিজ নিজ আবাসস্থলে বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার মধ্য দিয়ে পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতি যত্নবান হওয়ার বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এছাড়া পৃথিবীব্যাপী চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন তথা আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শক্তি উৎপাদন, যোগাযোগ, কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রের নানাবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাস করার মধ্য দিয়ে পরিবেশে কার্বনের পরিমাণগত ভারসাম্য রক্ষায় জিরো কার্বন পলিসি এবং ইউএনডিপি’র টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহও (এসডিজিস্) জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় প্যারিস চুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এই শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিসমূহ রোধ এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যতা বর্ধিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা। চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯, ১০ এবং ১১-তে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) গঠন, জলবায়ুর জন্য নিরাপদ প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিস্তারে কাঠামো তৈরীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সামাজিক এবং পরিবেশগত ঝুঁকির কারণগুলোকে হ্রাস করা গেলে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অসুস্থতা, মৃত্যুহার এবং অর্থনৈতিক ব্যয় মোট ক্ষতির এক-তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হয়। প্রকৃত অর্থে, পশুপাখির সাথে মানুষের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য বর্জন এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস না করে জীবের বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণই পারে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও মহামারি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে।
পরিবেশ রক্ষায় উৎযাপিত বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২০ এ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় প্রকৃতিকে বাঁচানোর এখনই হচ্ছে উপযুক্ত মুহূর্ত। মুখ থুবড়ে পড়া তথাকথিত উন্নততর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বৈশ্বিক যে দুর্দশার চিত্র মহামারি করোনাভাইরাসের আদলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা বাস্তবিক অর্থেই হতাশাব্যঞ্জক।
সমগ্র বিশ্বের উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনই নয়; প্রয়োজন পরিবেশ এবং সামাজিক ক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলোকে কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে হ্রাস করা। আর পৃথিবী নামক এই আবাসভূমিকে শাসন বা শোষণ করার মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিনির্ভর একটি যত্নশীল পৃথিবীর জন্য সবাই মিলে একযোগে কাজ করতে হবে যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতির মাঝে বৈরিতা নয় বরং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই বিরাজ করবে।
লেখক : প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।