বাজেট ২০২৫-২৬: এবারের বাজেট হবে একটি পরীক্ষার মঞ্চ
প্রকাশিতঃ 3:44 pm | May 31, 2025

সাইফুল হোসেন:
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। গণ-আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে ৯-১০ শতাংশে অবস্থান করছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূর্বের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে পৌঁছুলেও বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে সীমাবদ্ধতা থাকায় এলসি (ঋণপত্র) খোলা কমে গেছে, ফলে শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে এবং কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে।
এদিকে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পেয়েছে, বেকারত্ব বাড়ছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না বললেই চলে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বাজেট বাস্তবায়নের অনিয়ম দেশে এক প্রকার অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি করছে।
এ ধরনের বাস্তবতায়, একটি বাস্তবভিত্তিক, জনমুখী, সুশাসননির্ভর এবং দুর্নীতিমুক্ত বাজেটই পারে দেশের জন্য একটি পুনরুদ্ধারের রূপরেখা তৈরি করতে। বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, এটি সরকার পরিচালনার দর্শন এবং রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর জুন মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণা করে আসছে। এটি কেবল হিসাবের কাগজ নয়, একটি রাজনৈতিক ও আর্থিক দিকনির্দেশনার দলিল। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টেলিভিশনের পর্দায় বাজেট ঘোষণা হয়েছিল, আর এবার ২০২৫ সালে আবারও সেই নজির ফিরে আসছে। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন—তখনকার রাজনৈতিক শূন্যতা ও বর্তমানে চলমান অন্তর্বর্তী শাসনের অধীনে জনদাবির বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, যার অন্যতম কাজ হলো রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যক্রম সচল রাখা এবং রাজনৈতিকভাবে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা। তাদের বাজেট হতে হবে সংযত, বাস্তবসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সীমিত রাজস্ব সংগ্রহ, বৈদেশিক ঋণের শর্ত, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও দারিদ্র্য, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং সামাজিক বৈষম্য—এই বাস্তবতাগুলোকে মাথায় রেখে গঠন করতে হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ইতোমধ্যেই বলেছেন, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণই হবে প্রথম অগ্রাধিকার। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত, তবে এর সঙ্গে আরও যেসব খাতকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি তা হলো—কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দক্ষতা উন্নয়ন। এই খাতগুলোতে বিনিয়োগই পারে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা। করোনা মহামারি, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনমান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারিত করা জরুরি। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্বকালীন ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এই বেষ্টনীর আওতায় আনতে হবে। তবে ঘোষণার বাইরে গিয়ে এটি যেন বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
একই সঙ্গে বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা প্রশংসনীয়। রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেচব্যবস্থা, হাট-বাজার উন্নয়নের মাধ্যমে কেবল কর্মসংস্থানই সৃষ্টি হবে না; বরং দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতাও বাড়বে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমরা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় করি শিক্ষা খাতে, যেখানে মালয়েশিয়া ব্যয় করে ৪.৮%, ভারত ৩.১% এবং থাইল্যান্ড প্রায় ৪%। স্বাস্থ্য খাতেও আমরা ব্যয় করি মাত্র ১.০৫%, যা ভিয়েতনামের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ফলে সরকারি সেবাদান প্রক্রিয়া দুর্বল, চিকিৎসার মান নিন্মমানের এবং জনগণ বেসরকারি খাতে যেতে বাধ্য হয়।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, আর স্বাস্থ্য খাতে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোর সেবার মানোন্নয়ন—এই খাতগুলোর বরাদ্দ বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই হবে মানবসম্পদের উন্নয়ন।
অন্যদিকে, রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের ব্যর্থতা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ২১ শতাংশ ঘাটতি উদ্বেগজনক। করজাল সম্প্রসারণ, কর ফাঁকি রোধ, ই-ট্যাক্স ব্যবস্থা কার্যকর করাসহ কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
তবে কেবল বাজেট প্রণয়নই যথেষ্ট নয়; বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি, দেরিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন, অতিরিক্ত ব্যয় ও অনিয়ম প্রতিরোধে স্বাধীন ও কার্যকর মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। ভারতের মতো দেশ ICT নির্ভর বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশও সেই পথে এগোতে পারে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যারা বাজেট বাস্তবায়নে সফল, তাদের কাছ থেকে শেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
• ভিয়েতনাম বাজেটের ৩৫% সামাজিক খাতে ব্যয় করে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে।
• মালয়েশিয়া শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলেছে।
• চীন ব্যয়ের প্রতিটি ধাপেই ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করেছে, যা বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশকেও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য এই ‘ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (result-based budgeting)’ মডেলকে গুরুত্ব দিতে হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হবে একটি পরীক্ষার মঞ্চ। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য একটি কার্যকর রূপরেখা প্রণয়নের এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
বাজেট যেন সৎ, বাস্তবভিত্তিক, জনস্বার্থে প্রণীত হয় এবং এর বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং ও জবাবদিহিতা থাকে—এই প্রত্যাশাই এখন দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।