এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে হাস্যেজ্জ্বল খালেদা জিয়া, নতুন ইতিহাসের যাত্রাপথে গর্বিত ড.ইউনূস
প্রকাশিতঃ 10:25 pm | November 21, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো, সেনাকুঞ্জ থেকে :
প্রায় ১৪ বছর আগে শহীদ মইনুল রোডের বাসভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে। এরপর আর কখনও ক্যান্টনমেন্টের দিকে পা বাড়াননি দলটির শীর্ষ এই নেতা। অবশেষে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! নিজের চিরচেনা ক্যান্টনমেন্টে আবারও উপস্থিত বিএনপি চেয়ারপার্সন। এই উপস্থিতি চলতি বছরের সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সবশেষ ২০১২ সালে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় এক যুগ।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিকেল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে ছুটলো সেনাকুঞ্জের অভিমুখে। ৩টা ৫০ মিনিটে গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ারে করে ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জে গিয়ে বসলেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের ঠিক পাশের সোফায়। এর মাধ্যমে প্রায় ৬ বছর পর প্রকাশ্যে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। এর আগে সেনাকুঞ্জে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহুর্তে সেনাকুঞ্জ ছাড়ার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় হাস্যেজ্জ্বল দেখা গেছে তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে ঘিরে পুরো অনুষ্ঠান যেন হয়ে ওঠে খালেদা জিয়াময়। অনেকেই এগিয়ে যান তাঁর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতে। শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবরও জানতে চান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম বিনয় ও সম্মানের সঙ্গে কথা বলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপোসহীন লড়াকু নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে। কুশল বিনিময়কালে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেন মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার শরীর কেমন?’ এসময় খালেদা জিয়া জানান, ‘না, বেশি ভালো না।’ মাহফুজ আলম তখন বলেন, ‘আপনাকে ভালো থাকতে হবে। সামনে আসলে একটা কনফিডেন্স বের হয়।’
আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন ড.ইউনূস ও খালেদা জিয়া
নিজের পাশের সোফায় খালেদা জিয়াকে পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। আলাপচারিতায় মেতে ওঠতে দেখা যায় তাদের দু’জনকেই। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেগম খালেদা জিয়ার নজরকাড়া উপস্থিতিতে তাঁর অভিব্যক্তিও প্রকাশ করেন সোজাসাপ্টা উচ্চারণে। প্রধান উপদেষ্টা এ সময় বলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে এসেছেন। একযুগ তিনি আসার সুযোগ পাননি। আমরা গর্বিত এই সুযোগ দিতে পেরে।’ খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অসুস্থতা সত্ত্বেও বিশেষ দিনে সবার সঙ্গে শরিক হওয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ। আপনার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি।’
জানা যায়, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ২০১২ সালে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ২০১৩ সালে আমন্ত্রণ পেলেও যাননি তিনি। এবার নতুন বাংলাদেশে চলতি বছরের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বশরীরে গিয়ে তাকে নিমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান। এদিন গোটা অনুষ্ঠানে হাস্যেজ্জ্বল এক খালেদা জিয়ার উপস্থিতি দৃষ্টি কেড়েছে সবার। ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট সফরের পর নানা ঘটনা প্রবাহে আর প্রকাশ্যে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি খালেদা জিয়াকে। কিন্তু এই বছরের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান যেন নতুন এক ইতিহাস তৈরি করলো। সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। খালেদার গাড়ির সামনে ছিল মিলিটারি পুলিশের (এমপি) পাইলট কার ও পেছনে সেনাবাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্স।
এই অনুষ্ঠানে বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের সদর্প উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও তাঁর স্ত্রী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানাসহ আমন্ত্রিত জ্যেষ্ঠ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা কামাল হোসেন, জেএসডির আসম আবদুর রব, জোনায়েদ সাকী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ভিপি নুরুল হক নূরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
তিন বাহিনী প্রধানকে মির্জা ফখরুলের ধন্যবাদ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালে ষড়যন্ত্রমূলক দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দুই বছর কারাগারে থাকার পর ২০২০ সালের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। সাময়িক মুক্তির পর থেকে তিনি কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর বাইরে কখনো বাসা থেকে বের হননি। রাজনৈতিক কর্মসূচি বা কোনো ধরনের অনুষ্ঠানেও তাকে দেখা যায়নি। খালেদা জিয়া এদিন বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় সড়কে জড়ো হওয়া বিএনপিকর্মীরা পুরো এলাকা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন।
সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠান শেষে বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জে যাওয়ার এই ঘটনা গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখবে। এ সময় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে- সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর যারা প্রধান আছেন তাদেরকে, যারা অধিকর্তা আছেন তাদেরকে। ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে- আজকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এজন্য যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই ঘোষণাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে আপসহীন সংগ্রাম, এই দীর্ঘ বছর বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম, সেই সংগ্রামকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এদেশের মানুষ যে সংগ্রাম করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, প্রাণ দিয়েছে, তাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রাণগুলো চলে গেল, তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা নিঃসন্দেহে এই কথায় স্মরণ করতে চাই, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের থেকে অনেক দূরে আছেন, আজকে তিনিও সবচেয়ে বেশি আনন্দিত, দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যে আজকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি (খালেদা জিয়া) তার যে জায়গা, সেই জায়গা তিনি যেতে পেরেছেন।’
কালের আলো/এমএএএমকে