অসম সাহসে আশা জাগিয়েছেন সেনাপ্রধান, দৃঢ় প্রত্যয় ধৈর্য্য ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের
প্রকাশিতঃ 11:07 pm | November 19, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর টানা তিনদিন সরকারবিহীন ছিল দেশ। এ সময়ে দেশের সার্বিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের। তিনি সাধারণ ভাষায় অথচ অসাধারণ বুৎপত্তির সঙ্গে সেদিন বলেছিলেন, ‘আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি। এখনই আশাহত হবেন না। আপনাদের যত দাবি আছে, তা আমরা পূরণ করব এবং দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনব।’ অভিভাবকহীন দেশে গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। শুরু হয় নতুন বাংলাদেশের পথচলা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যতের বাংলাদেশে নতুন দিগন্তের উন্মোচনে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অসম সাহসে লড়াই করে আশা জাগিয়েছেন সেনাপ্রধান। তাঁর এই যাত্রাপথ ফুল বিছানো ছিল না মোটেও। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতে হয়েছে, হচ্ছে তাকে। ইতিহাস যেন তার কাঁধে দিয়েছে অনেক দায় ও দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার এই অগ্রদূত দায়িত্ব পালনেও ক্লান্তিহীন এক যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে রূপান্তরিত করেছেন।
স্বল্প সময়ের মধ্যেই জনরোষে জনগণের কাঠগড়ায় স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকা পুলিশকে দায়িত্ব পালনে তিনি সক্রিয় করেছেন। ফিরতে শুরু করে পুলিশের হারানো আত্মবিশ্বাস। দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টহল ও তল্লাশির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও তাঁর নির্দেশনায় সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। পরিচালনা করছে যৌথ অভিযানও। নিয়মিত উদ্ধার করছে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি মহানগরী ও জেলা শহরে ক্যাম্প স্থাপন করে মানুষকে সেবা দিচ্ছে তাঁরা। দেশের চরম ক্রান্তিকালে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড.মুহাম্মদ ইউনূসও প্রশংসা করেছেন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীর।
দু’দফায় ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে সব রকমের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। প্রথম দফা ৬০ দিনের ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতায় ৬ হাজারের বেশি অস্ত্র, ২ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী, গ্রেপ্তার করেছে আড়াই হাজার ব্যক্তিকে। সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে বিশৃঙ্খলার অবসান হয়েছে। গত দুই মাসে সাতশর বেশি বিভিন্ন ধরনের ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ১৪১টি, সরকারি সংস্থা বা অফিস সংক্রান্ত ৮৬টি ও রাজনৈতিক দলের ঘটনা ছিল ৯৮টি।
- অর্জন করেছেন অগাধ বিশ্বাসযোগ্যতা
- তাঁর এই যাত্রাপথ ফুল বিছানো ছিল না মোটেও
- অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতে হয়েছে, হচ্ছে তাকে
- দেশকে স্থিতিশীল রাখতে প্রতিটি বিষয় সমন্বয়, তদারক ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন
- ফ্রেমওয়ার্ক ধরে সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা
- উজ্জ্বল করেছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি
- প্রমাণ করেছেন তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন
সূত্র জানায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গভীর দৃষ্টি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেশকে শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। শুধুমাত্র রুটিন কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নির্ধারণ করে প্রতিনিয়ত ছুটছেন সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন, কুতুবদিয়া থেকে তেতুলিয়া। দেশের চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন নিজ বাহিনীর সদস্যদের। দেশকে স্থিতিশীল রাখতে সঠিকভাবে প্রতিটি বিষয় সমন্বয়, তদারক ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অর্জন করেছেন অগাধ বিশ্বাসযোগ্যতা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করায় অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) তিনি ৭ পদাতিক ডিভিশন ও বরিশাল এরিয়া পরিদর্শনকালে ৭ পদাতিক ডিভিশন ও বরিশাল এরিয়ায় কর্মরত সকল পদবির সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে ‘দরবার’ ও সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ গ্রহণকালে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও ন্যায়পরায়ণতার সূচকে গুরুত্বপূর্ণ এমন মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন। দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বৈষম্যহীন স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে সর্বাত্মকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে রয়েছে তাঁর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সেনাপ্রধান একাধিকবার বলেছেন, কোনভাবেই এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। ফলত এই যাত্রাপথকে সহজ ও নিষ্কন্টক করতে গভীর মমত্ববোধ আর ভালোবাসায় নিজেদের দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছে সেনাবাহিনী। প্রতিনিয়ত নিজেদের ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছেন প্রতিটি সেনা সদস্য। যেকোন অনভিপ্রেত ও অনাহুত পরিস্থিতিতে নিজেদের সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন অবিরাম। এ সময়টিতে কোনভাবেই যেন মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে নিজেদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পুনরায় সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করেছে।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, ৭ পদাতিক ডিভিশন ও বরিশাল এরিয়ায় কর্মরত সকল পদবির সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে ‘দরবার’ ও সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ গ্রহণকালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সকল সেনাসদস্যকে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ধৈর্য্য ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে অসামরিক প্রশাসন এবং দেশের জনসাধারণকে সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্র প্রদত্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রয়োগ করে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রতিটি সেনা সদস্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সকলকে প্রস্তুত থাকতেও নির্দেশনা প্রদান করেছেন। নবনির্মিত সেনানিবাসের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সেনাপ্রধান ৭ পদাতিক ডিভিশনে চলমান বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন ।
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করায় অবস্থার উন্নতি হচ্ছে
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান
সূত্র জানায়, সেনাপ্রধান ধারাবাহিকভাবে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া পরিদর্শন করছেন। গত রবিবার (১৭ নভেম্বর) ও সোমবার (১৮ নভেম্বর) তিনি কক্সবাজার এরিয়া পরিদর্শন করেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবরে তিনি একে একে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি রিজিয়নের নানিয়ারচর জোন সদর, ৩৩ পদাতিক ডিভিশন ও কুমিল্লা এরিয়া, ১১ পদাতিক ডিভিশন ও বগুড়া এরিয়া এবং ৬৬ পদাতিক ডিভিশন ও রংপুর এরিয়া পরিদর্শন করেন। চলতি মাসেও ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন তিনি। চট্টগ্রামের হালিশহর আর্টিলারী সেন্টার ও স্কুলে সেনাবাহিনীর রেজিমেন্ট অব আর্টিলারির ৪৩তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। খুলনা সফরকালে স্থানীয় জাহানাবাদ সেনানিবাসস্থ এএসসি সেন্টার এন্ড স্কুলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) ৪৩তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছেন। সেনাপ্রধানের এসব সফরের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি সেনাসদস্যের মনোবল বেড়েছে বহুগুণে। মাঝখানে প্রায় ১০ দিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন তিনি। সফরকালে সেনাপ্রধান জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তিরক্ষা মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং কানাডার উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানে সারি সারি লাশ আর রক্তস্রোত থামাতে সেনাপ্রধান গভীর দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দেশপ্রেমের সুকঠিন পরীক্ষায় অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সেদিন সেনাপ্রধান অমিত সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয়ে দূরদর্শী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। তিনি গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসার। গত সাড়ে ৩ মাস আগে দেওয়া বক্তব্যের আশা জাগানিয়া প্রতিফলন তিনি ইতোমধ্যেই দেশবাসীকে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ফ্রেমওয়ার্ক ধরে সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। একজন সৈনিক হিসেবেও তিনি নিজের বাহিনীকে পেশাদার রেখেছেন। প্রমাণ করেছেন তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন। সবাই আশাবাদী সামনের দিনগুলোতেও দেশের মানুষের ভালোবাসা ও সংহতিতে একতাবদ্ধ থেকে সেনাপ্রধান সফল হবেন। এরই মধ্যে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনে স্বপ্নের পথকে তিনি মসৃণ করেছেন। এমন ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সংস্কার অভিমুখে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রাও সফলতার সোপান স্পর্শ করবে অভিমত বিশ্লেষকদের।
কালের আলো/এমএএএমকে