সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে শব্দদূষণ
প্রকাশিতঃ 11:38 am | November 13, 2024
মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
রাজধানী ঢাকার নিত্যকার চিত্র যানজট। ঢাকাবাসীর জীবন থেকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেড়ে নিচ্ছে যানজট। সড়কের মোড়ে মোড়ে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না যানজট নিরসন। বর্তমান সময়ে সড়কে শৃঙ্খলা যেন রীতিমতো উধাও। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা নিয়েও অন্ত নেই সমালোচনার। চলমান এই ত্রাহি অবস্থার মধ্যে আবার দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে শব্দদূষণের সহনীয় মাত্রা। এতে করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন রাজধানীবাসী। শ্রবণশক্তি হ্রাস, মাথা ব্যথা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অস্থিরতা বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিদ্রাসহ বিভিন্ন রোগের জন্য শব্দদূষণকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার ও মোটর সাইকেলসহ বিচিত্র রকমের যানবাহন সড়কে অযথা হর্ন বাজিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহারের ফলে এ অবস্থা দিনকে দিন প্রকট আকার নিয়েছে। কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা নেই। যদিও রাজধানী ঢাকাকে হর্নমুক্ত করতে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রথমে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে, পরে পুরো ঢাকা শহর এবং ধীরে ধীরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও শব্দদূষণ বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
- হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করতে ডিসেম্বর থেকে জরিমানা
- যানবাহন সড়কে অযথা হর্ন বাজিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত
- শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ
- মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন রাজধানীবাসী
- ‘কম শব্দযুক্ত’ দেশ গড়ার অঙ্গীকার পরিবেশ উপদেষ্টার
হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণে বিধিতেও পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। কিন্তু নীরব ঘাতক শব্দদূষণ ঠেকানো যাচ্ছে না কোনভাবেই। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বছরখানেক আগে শব্দদূষণ নিয়ে এক গবেষণায় জানিয়েছিল, আগে রাজধানীতে গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় ধরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হতো। এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, রাজধানীতে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে দিন দিন শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে নগরীর বাসিন্দারা।স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীসহ সব ধরনের মানুষ শব্দদূষণের ভুক্তভোগী। শিশু এবং বয়স্ক ও রোগীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে। এমনকি শব্দদূষেণের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না ট্রাফিক পুলিশও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে তাদের কানে সমস্যা হয়। দীর্ঘদিন সড়কে কাজ করতে গেলে পেটের নানাবিধ সমস্যাও হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে বাসায় গিয়েও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা সম্ভব হয় না। শুধু তাই নয়, শব্দদূষণের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহের রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে, পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়, শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, মানুষের শ্রবণশক্তির সহনীয় মাত্রা হলো ৫০ ডেসিবল। কোনো এলাকায় ৬০ ডেসিবলের বেশি মাত্রার শব্দ হলে সেই এলাকা দূষণের আওতায় বলে চিহ্নিত হবে। ৬০ ডেসিবল শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িকভাবে নষ্ট বা অকেজো করে দিতে পারে। আর ১০০ ডেসিবল শব্দে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। বিপরীতে বেসরকারী সংস্থার এক জরিপ বলছে, ঢাকা শহরেই এই শব্দের মাত্রা কখনও কখনও ১২৫ ডেসিবল ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে সিএনজিতে ১০৮, বাস ও মিনিবাসে ১১০, ট্রাক ও প্রাইভেটকারে ১২৫ ডেসিবল মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শব্দের সহনীয় মাত্রা বিবেচনায় শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করে এসব এলাকার শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবল, নীরব এলাকায় ৪৫ ডেসিবল, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ডেসিবল, রাতের জন্য সর্বত্র ১০ ডেসিবেলের কম মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, গুলিস্তান, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাস বা প্রাইভেটকারের চালকরা অনবরত হর্ন বাজাচ্ছে। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থেকেও তারা একের পর এক হর্ন দিয়ে যাচ্ছেন। একই চিত্র সিএনজিচালিত অটো রিকশা ও মোটর সাইকেলগুলোর ক্ষেত্রেও। ঘন ঘন হর্ন বাজানোর কারণ জিজ্ঞাস করতেই রাজধানীর বনানী এলাকার এক প্রাইভেটকার চালক গজর গজর ভঙ্গিতে বলেন, ‘এটি কি বিদেশ পেয়েছেন? ঢাকায় হর্ন না দিলে কেউ সাইড দিতে চায় না। তখন এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’
রাজধানীর সড়কে হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করতে আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর অ্যাকশন শুরু করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি বলেছেন, হর্ন বাজানোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে প্রথমে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। এরপর আইনের প্রয়োগ। জরিমানা কার্যকর করার আগে সব ধরনের গাড়িচালক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হবে।
তিনি বলেন, ‘হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করতে ডিসেম্বর থেকে জরিমানা কার্যকর করা হবে। প্রথমবার আইন ভঙ্গ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার করলে আরও বেশি টাকা জরিমানা করা হবে।’ ঢাকায় যানবাহনের হর্নে মানুষের শ্রবণশক্তি কমছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এটি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্নায়ুরোগ সৃষ্টি করতে পারে। চালকদের হর্ন না বাজাতে উৎসাহিত করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, লাইসেন্স নবায়নের শর্ত হিসেবে হর্ন বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ঢাকা শহরে হর্ন ছাড়াও মাইকিং, বিজ্ঞাপন, নির্মাণকাজসহ বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে। নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য হর্নসহ অন্য সব শব্দ বন্ধ করে একটি ‘কম শব্দযুক্ত’ দেশ গড়ার কথা উল্লেখ করেন এই পরিবেশ উপদেষ্টা।
কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে