কর্ণফুলী টানেল; আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি নেই ব্যয়ের
প্রকাশিতঃ 11:36 pm | October 28, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:
টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড় আয় ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বিপরীতে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে ব্যয় গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। কর্তৃপক্ষের দৈনিক লোকসান ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। সে হিসাবে গত ১১ মাসে ক্ষতি ৮৩ কোটি টাকার বেশি। এই চিত্রটি কর্ণফুলী টানেল’র। এর একদিকে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি নেই। অন্যদিকে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে টানেল রক্ষণাবেক্ষণে। ফলে দিন যত যাচ্ছে, টানেলটি যেন তার উপযোগিতা হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে টানেলটির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় টানেলে যান চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রাক্কলন অনুযায়ী, টানেলে শুরু থেকে দৈনিক ২০ হাজার ৭১৯টি গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যা ২০২৫ সাল নাগাদ ২৮ হাজার ৩০৫টি ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৭ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু চালুর প্রায় এক বছরের এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার যানবাহন চলাচল করছে। তাই বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে পাঁচ হাজার গাড়িও চলাচল করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, গত সোমবার (২৮ অক্টোবর) টানেল উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক নতুন শহর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে টানেলটি নির্মাণ হলেও উদ্বোধনের এক বছর পর সে স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে বড় কোনো শিল্পায়ন না হওয়া, চায়না ইকোনমিক জোনের ভবিষ্যৎ ঝুলে থাকা, কর্ণফুলী সেতুর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টোল নির্ধারণ, থ্রি হুইলার চলাচলের অনুমতি না থাকাসহ নানা কারণে টানেলে কাঙ্ক্ষিত গাড়ি চলাচল করছে না। এতে টানেলে যে পরিমাণ অর্থ আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা খরচ পোষাতেও পারছে না টানেল কর্তৃপক্ষ।
টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি। তা থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
অন্যদিকে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টানেলের প্রভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে সেভাবে আলো ফেলতে পারেনি এটি। উল্টো আগের অর্থবছরের তুলনায় সর্বশেষ অর্থবছরে চট্টগ্রামে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় তিন হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য বিডায় নিবন্ধন নিয়েছে। অথচ এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার ৭২৬ কোটি টাকার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে দুই হাজার ২৭৫ কোটি ৭৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা বা ৩৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। প্রায় দশ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প কেন এত লোকসান গুনছে তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ খুঁজতে গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শনে এসেছেন।
টানেলকে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ বিলাসী এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন বলে মন্তব্য করে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, কাল্পনিক সমীক্ষার ভিত্তিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, যার নিষ্ফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে। ওয়ান সিটি টু টাউন করার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে অথচ কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর মাধ্যমেই ওয়ান সিটি টু টাউন বাস্তবায়ন হয়েছে। যে পরিমাণ অর্থ টানেলে ব্যয় করা হয়েছে সে অর্থ দিয়ে তিনটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করা যেত।
টানেলের পরিকল্পনাবিদদের জ্ঞানহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের একটি পরিকল্পনা করতে হলে যথেষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন, আবেগ দিয়ে পরিকল্পনা হয় না, এটা এখন ঋণ করে মিষ্টি খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের জন্য ঋণ দিয়েছে তারাও এর দায় এড়াতে পারেন না।
কালের আলো/এমএএইচ/এমএস