উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
প্রকাশিতঃ 11:06 pm | October 17, 2024
মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো :
স্বাস্থ্য-গণমাধ্যমসহ আরও চার খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের তথ্য এবং কাগজপত্র হাসপাতাল থেকে সরানোর সঙ্গে জড়িত দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানিয়েছে। হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে অবসরে পাঠানোর বিষয়েও সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এতে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি বলেও স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
- স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক চারটি নতুন সংস্কার কমিশন
- হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে অবসরে পাঠানোর বিষয়ে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি
- জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হাসপাতাল থেকে নিহতদের তথ্য-প্রমাণ লোপাটকারীর শাস্তি দেবে সরকার
- প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৩০ লাখ টাকা
- রাজধানীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ওঠে আসে শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার জাতির পিতা মনে করে না, তথ্য উপদেষ্টার এই বক্তব্যের বিষয়টিও। এই প্রসঙ্গেও সুস্পষ্ট জবাব দেন পরিবেশ উপদেষ্টা। রাজধানীর যানজট নিরসনে শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থায় যুক্ত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও নিশ্চিত করেছেন।
স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক চারটি নতুন সংস্কার কমিশন
স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক চারটি নতুন সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, নবগঠিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ খানকে, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বিশিষ্ট কলামিস্ট কামাল আহমেদ, শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রধান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ ও নারী বিষয়ক কমিশনের প্রধান নারী পক্ষের শিরিন পারভীন হক। শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে ভবিষ্যতে কমিশন গঠনের সম্ভাবনার কথাও জানান এই উপদেষ্টা। এর আগে, দেশের বিভিন্ন খাত সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। গত ৬ অক্টোবর সংবিধান সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশিত হয়।
হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে অবসরে পাঠানোর বিষয়ে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি
হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে অবসরে পাঠানোর বিষয়ে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি বলে মনে করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিচার বিভাগের অস্থিরতা বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন বিচার বিভাগের অনেক সিদ্ধান্ত সেটেল করা হয়নি। কারণ রাজনৈতিক সরকারগুলো সব সময় তার ইচ্ছায় ব্যবহার করতে চেয়েছে, ফলে সেই বিষয়গুলো সেটেল করেনি। তাই সেগুলো সেটেলমেন্টের দায়িত্ব আমাদের কাঁধে এসেছে। প্রধান বিচারপতি বিচারপতিদের নিয়মের মধ্যে ছুটি দিয়েছেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচারপতিদের অপসারণ কে করতে পারবেন তা নিয়ে দেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। একদিকে মুখে বিচার বিভাগ স্বাধীনের কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে বিচারবিভাগ রাজনৈতিক সরকারের অবস্থান থেকে একচুলও না নড়তে পারে সেই পুরো ক্ষমতাটায় সংসদকে দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব যে মামলাটা ঝুলে আছে, বন্ধের পর পর যেন সুরাহা হয়ে যায়। যার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগের বিচারকরা থাকতে পারবেন না, সেটার সমাধানের দিকে যাওয়া যাবে। তবে সেটা নিয়ম মেনে করা হবে।
যানজট নিরসনের সরকারের উদ্যোগ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে বলে জানান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে আমরা শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্ত করতে পারি কিনা, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কারণ অপেক্ষা করা, সময় দেওয়ার সীমা আছে। আবার জনগণের ভোগান্তিটা নিরসন করতে হবে। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থায় যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
সাকিব আল হাসানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যেটুকু জানি উনি নিজেই বলেছেন নিরাপত্তার কারণে আসছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তার কারণে আসবেন না, এমন কোন কথা বলা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন না’- এটা নিয়ে সরকারের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন,এ বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা ডিটেইল বক্তব্য দিয়েছেন।
শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, যারাই আন্দোলন করছে তাদের মুখপাত্র আছে। কোনো আন্দোলনকারীর জন্য সরকার দরজা বন্ধ করেনি। তারা যদি মনে করে রাস্তায় আন্দোলন না করে সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনা করবেন, সেটা আন্দোলনকারীদের জন্য দরজা খোলা আছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুশ্চিন্তার বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, তাদের একটি পক্ষ থেকে আট দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকার সে দাবিগুলো বিবেচনায় নিচ্ছে। আমরা তাদের আশস্ত করতে চাই নতুন বাংলাদেশে ধর্মীয় পরিচয়ে, সংখ্যালঘু পরিচয়ে কারও অনিরাপদবোধ করার কারণ নেই।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কীনা- এমন প্রশ্নে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচারের প্রয়োজনে আমাদের আনতে হলে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করব। যেহেতু ট্রাইব্যুনাল থেকে নির্দেশনা এসেছে, তাই বিচারের প্রয়োজন হয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন, হাসপাতাল থেকে নিহতদের তথ্য-প্রমাণ লোপাটকারীর শাস্তি দেবে সরকার
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের তথ্য এবং কাগজপত্র হাসপাতাল থেকে সরানোর সঙ্গে জড়িত দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করার সিদ্ধান্তের কথা জানান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আহত-নিহতদের একটা ভেরিফায়েড তালিকা হয়েছে। এই তালিকা করতে গিয়ে একটি বিষয় আমাদের ভোগাচ্ছে, শহীদ বলেন, আর আহত বলেন, উভয় ক্ষেত্রে। সে সময় হাসপাতালগুলো থেকে কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার একটা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অনেক কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার কারণে আমরা অনেক জায়গা থেকে তথ্য পেলেও হাসপাতাল থেকে ক্রসচেক করতে পারছি না।
এই উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের কাছে ভেরিফায়েড লিস্ট বাদেও আরেকটা লিস্ট আছে। সেটাকে আমাদের একটু মাঠ পর্যায় থেকে যাচাই-বাছাই করে আনতে হচ্ছে। যারা কাগজপত্র সরিয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে বলেন, সরকার আজকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সব হাসপাতাল থেকে এ রকম কাগজপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যারা নির্দেশ দিয়েছেন, যারা কাগজপত্র সরিয়েছেন তাদের সবার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে এবং আমরা সেই দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করবো।
প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৩০ লাখ টাকা
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এ টাকা প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে যদি আরো প্রয়োজন হয় যাচাই-বাছাই করে সেটাও প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন শুধু তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, যারা আহত হয়েছেন তাদের পরিবারকেও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আহতদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আগামী সপ্তাহে একটি দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আহতের যদি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় সেটি করা হবে। ইতোমধ্যে সাতজনের একটি তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। যদি আরও বেশি প্রয়োজন হয় আমরা সেটি করব। তিনি আরও বলেন, আহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনোরকম গাফিলতি বরদাশত করা হবে না। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে বলে দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে বিনা পয়সার চিকিৎসা দেওয়া হবে। তারপরও যারা পয়সা নিয়েছে তাদেরকে বলে দেওয়া হয়েছে পয়সা ফেরত দেওয়ার জন্য।
কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে